আবু করিমকে জোহরা খানমের Hope ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি বিস্মিত হয়ে দেখলেন, কেবিনের বেঙের সঙ্গে তাঁর হাত-পা বেঁধে ফেলা হয়েছে। হাতপা বাঁধা হবার পর অল্পবয়েসি একটা নার্স সিরিঞ্জ নিয়ে ঢুকল ইনজেকশন দেবার জন্যে। তিনি বললেন, কী ইনজেকশন দিচ্ছ?
নার্স বলল, দাদু! কী ইনজেকশন দিচ্ছি সেটা তো আপনার জানার দরকার নেই।
আবু করিম বললেন, জানার দরকার আছে। আমি একজন ডাক্তার।
নার্স বলল, এখানে যারা ভর্তি হয় তারা সবাই এই ধরনের কথা বলে। কেউ ডাক্তার, কেউ মন্ত্রী, কেউ আবার মিলিটারির জেনারেল। ফিল্ড মার্শাল।
তুমি ডা. জোহরা খানমকে খবর দিয়ে আন। তার সঙ্গে কথা বলা দরকার।
দাদু! উনি প্রয়োজন ছাড়া আসেন না। ইনজেকশন দিয়ে দিচ্ছি, টানা বারো ঘণ্টা ঘুমাবেন।
মা শোন, আমি সত্যি একজন ডাক্তার।
নার্স বলল, ডাক্তার দাদু! আরাম করে ঘুমান। ইনজেকশন দিয়ে দিয়েছি। এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়বেন।
দাদু ঘুমালো পাড়া জুড়ালো
বর্গী এল দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দিব কিসে?
আবু করিম টানা দশ ঘণ্টা ঘুমালেন। ঘুম ভাঙার এক ঘণ্টার মধ্যে আরেকটা ইনজেকশন দিয়ে আবারো তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হলো। হাত এবং পায়ের বাঁধন খোলা হলো না।
ভূত বিশেষজ্ঞ বিখ্যাত থিয়সফিস্ট
ভূত বিশেষজ্ঞ বিখ্যাত থিয়সফিস্ট এবং মিডিয়ামের চেহারা খানিকটা ভূতের মতো। চোয়াল ভাঙা। দুই জুলফিতে সামান্য পাকা চুল ছাড়া মাথায় একটা চুলও নাই। মানুষের মাথা সচরাচর গোলকার হয় না। ইনারটা পারফেক্ট sphere। চোখ ইঁদুরের মতো পুঁতি পুঁতি। চোখের মণি স্থির না। মনে হয় সারাক্ষণ কিছু খুঁজছে। হয়তোবা ভূতই খুঁজছে। অতিরিক্ত রোগা একজন মানুষ। রোমান সিনেটারদের মতো গেরুয়া চাদর পরেছেন। ভদ্রলোকের নাম প্রফেসর টি আলি নরুন্দ।
তিনি কোনো কলেজের অধ্যাপক না। ম্যাজিশিয়াম এবং জোতিষীরা যেমন নামের আগে প্রফেসর লাগান ইনিও লাগিয়েছেন। নামের শেষের নরুন্দ কবি রবীন্দ্রনাথের দেয়। রবীন্দ্রনাথ একবার প্ল্যানচেটে এসে বললেন, আলি শোন, তুই নামের শেষে নরুন্দ লিখবি।
প্রফেসর টি আলি বিনয়ের সঙ্গে বললেন, নরুন্দ শব্দটার অর্থ কী গুরুদেব?
গুরুদেব বললেন, পরকালে আমার প্রধান কাজ হচ্ছে নতুন নতুন শব্দ তৈরি করা। নরুন্দ শব্দটা কিছুদিন হলো তৈরি করেছি। এই শব্দ দিয়ে একটা গানও লিখেছি। দীর্ঘ তিন অন্তরার গান। প্রথম লাইন— গগনে গগনে নরুন্দের খেলা। নরুন্দ শব্দটার মানে দিয়েছি মেঘ। পরকালের শব্দ তো। ইহকালে তুমি ইচ্ছা করলে অন্য মানেও করতে পার।
প্রফেসর টি আলি নরুন্দ তার নামকরণের ইতিহাস বর্ণনা করে বললেন, এখন বলুন আপনাদের জন্যে কী করতে পারি? মৃত আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলতে চান? কথা বলিয়ে দেব। তবে টাটকা মরা হলে দ্রুত আত্মা নিয়ে আসব। দশ-বারো বছর হয়ে গেলে সমস্যা।
কাদের খান ভয়ে ভয়ে বললেন, কী সমস্যা?
আত্মা ঊর্ধ্বলোকে চলে যায়। ডেকে আনতে কষ্ট হয়। রবীন্দ্রনাথের আত্মাকে অনেকবার এনেছি তো, এখন ডাকলেই চলে আসেন। আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। স্নেহ করেন বলেই নাম দিয়েছেন নরুন্দ। কবিগুরুর স্নেহ পাব কখনো ভাবি নি।
সানাউল্লাহ বললেন, আমরা আসলে কোনো আত্মার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছি না। ভূত-প্রেত বিষয়ে জানতে এসেছি। ভূত নিয়ে একটা বই লিখছি বলেই জানতে চাচ্ছি। শুনেছি এই বিষয়ে আপনার অগাধ জ্ঞান।
নরুন্দ বললেন, অল্পকিছু জানি। অহঙ্কার করার মতো কিছু না। আইনস্টাইনের মতো বলতে হয়–আমি জ্ঞানসমুদ্রে নুড়ি কুড়াচ্ছি।
সানাউল্লাহ বললেন, স্যার, কিছু মনে করবেন না। কথাটা বিজ্ঞানী নিউটনের।
নরুন্দ কঠিন চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, কথাটা আমি সরাসরি আইনস্টাইনের কাছে শুনেছি। প্রায়ই চক্রে উনাকে আহ্বান করা হয়। উনার কাছ থেকে পদার্থবিদ্যার নানান কথা শুনি। পরকালেও গবেষণার মধ্যে আছেন। তবে বেচারা অত্যন্ত লজ্জিত।
কাদের খান বললেন, লজ্জিত কেন?
স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটিতে তিনি কিছু ভুল করেছেন। এই ভুলটা পৃথিবীর পদার্থবিদরা ধরতে পারছেন না বলেই লজ্জিত। ভুলটার কারণেই ডার্ক ম্যাটার নিয়ে বিভ্রান্তি থেকেই যাচ্ছে। আইনস্টাইন স্যারের কাছ থেকে অদ্ভুত অদ্ভুত জ্ঞানের কথা শুনি। এত ভালো লাগে।
কাদের খান বললেন, একটা জ্ঞানের কথা আমাদের বলুন। প্লিজ।
নরুদ সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, ইহকালে আলোর গতি ধ্রুব। সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল। কিন্তু পরকালে আলোর গতি ধ্রুব না। যে যার ইচ্ছামতো আলোর গতি ঠিক করতে পারে। এই কারণে পরকাল হচ্ছে আলোরই খেলা। আপনারা চা খাবেন?
সানাউল্লাহ বললেন, চা খাব না। ভূত বিষয়ে যদি কিছু বলেন। অনেক দূর থেকে এসেছি।
নরুন্দ বললেন, চার-পাঁচ মিনিটে তো কিছুই বলতে পারব না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে হবে। এত সময় আমার নেই। আপনাদেরও নিশ্চয়ই নেই।
সানাউল্লাহ বললেন, আমাদের সময়ের সমস্যা নেই। আপনার সমস্যাটাই প্রধান।
বেসিক জিনিসগুলি আজ বলে দিচ্ছি। আরেকদিন অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে চলে আসবেন, আপনাদের চক্রে ঢুকিয়ে দেব। সরাসরি আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ হবে।
কাদের খান বলল, স্যার, আপনি যেদিন অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেবেন সেদিনই চলে আসব।
নরুন্দ বললেন, চক্রে বসার ফি বাবদ আমি পার পারসন দুই হাজার করে টাকা নেই। আগেভাগেই বলে দিলাম।