সানাউল্লাহ বললেন, একটা এক্সপেরিমেন্ট করো না। তোমার মতো ব্রিলিয়ান্ট ফিজিসিস্টের কাছে ভূত প্রমাণ করা কোনো বিষয়ই না।
আইনুদ্দিন বললেন, আমি চিন্তা শুরু করে দিয়েছি। কোন লাইনে এগুচ্ছি শুনতে চাও?
চাই।
ভূতকে শুরুতেই আমি পদার্থ হিসেবে ধরছি। এখন বলো পদার্থের অবস্থা কয়টা?
সানাউল্লাহ বললেন, তিনটা। কঠিন, তরল এবং বায়বীয়।
অইনুদ্দিন বললেন, পদার্থের অবস্থা ছয়টা। চতুর্থ অরস্থা হচ্ছে Plasma State. এই অবস্থায় পদার্থের সব পরমাণু একসঙ্গে চলে আসে এবং সব ইলেকট্রন মেঘের মতো পরমাণুর চারপাশে ঘুরপাক খেতে থাকে।
বলো কী!
প্লাজমা অবস্থা তৈরিতে প্রচুর তাপ লাগে। প্রায় এক লক্ষ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার প্রয়োজন। যাই হোক, পদার্থের অবস্থার নাম Bose-Einstein Condense পরম শূন্য তাপমাত্রায় পদার্থের এই অবস্থা হয়। পরম শূন্য অপমাত্রা কত জানো?
না।
আইনুদ্দিন বললেন, পরম শূন্য তাপমাত্রা হলো মাইনাস ২৭৩ দশমিক এক ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই তাপমাত্রায় কোনো বস্তুকে নিয়ে গেলে একটি পরমাণু গুচ্ছ তৈরি হয়। অর্থাৎ সব পরমাণু একত্রিত হয়ে যায়। বেসি কণার ব্যাপারে ব্যাপারটা সহজে ঘটে। বোস কণা চেন?
আরে না। আমি এইসব চিনব কীভাবে?
বোস কণার কৌনিক ভরবেগ অর্থাৎ Intrinsic angular momentum হবে পূর্ণ সংখ্যা। বুঝতে পারছ?
সানাউল্লাহ কিছুই না বুঝে বললেন, জটিল বিষয়, কিন্তু অনেকটা স্পষ্ট হয়ে আসছে।
আইনুদ্দিন বললেন, এখন বলি Fermion কণার কথা। এদের কৌণিক ভরবেগ হয় অর্ধপূর্ণ সংখ্যা। যেমন, ১/২ হতে পারে, ৩/২, হতে পারে, ৫/২ হতে পারে। পরিষ্কার না?
অবশ্যই পরিষ্কার। জলের মতো না হলেও পরিষ্কার।
আইনুদ্দিন বললেন, ফারমিওন কণা নিয়ে যখন সুপার অ্যাটম তৈরি হবে সেটি হবে পদার্থের ষষ্ঠ অবস্থা। এখন কী দেখলে? পদার্থের ছয়টা অবস্থা। ভূত পদার্থের অন্য এক অবস্থা তো হতে পারে। সপ্তম অবস্থা। হতে পারে না?
অবশ্যই পারে।
আইনুদ্দিন চিন্তিত গলায় বললেন, ভূতের কণার কৌণিক ভরবেগ হয়তো Boson বা Fermion-এর চেয়ে আলাদা। খুবই জটিল অবস্থা। তুমি চলে যাও, আমি চিন্তা করতে থাকি। তোমার ভাবি বাসায় না থাকায় চিন্তা করাটা আমার জন্যে সহজ হয়েছে। তুমি একটা কাজ কর। মোড়ের দোকান থেকে ফ্লাস্ক ভর্তি করে চা এনে রেখে যাও। তোমার ভাবি শুধু যে একা চলে গেছে তা-না। রহমতকেও সঙ্গে নিয়ে গেছে। উদ্দেশ্য আর কিছু না। আমাকে যন্ত্রণা দেয়া।
সানাউল্লাহ ফ্লাস্ক ভর্তি চা, পাউরুটি, কলা, বিসকিট, চানাচুর এবং দুটা সিদ্ধ ডিম আইনুদ্দিনের টেবিলে রেখে আবু করিমের সন্ধানে গেলেন। তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন এই খবর পাওয়া গেছে।
আবু করিম সাহেব বাসায় নেই। তাঁর স্ত্রী ডা. শায়লা তাকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে নিয়ে গেছেন। সাইকিয়াট্রিস্টের নাম ডা. জোহরা খানম। হেড মিসট্রেস টাইপ চেহারা। নাকের নিচে লাল চুলের গোঁফ আছে। তাঁর শরীর প্রকাণ্ড। মুখের হা প্রকাণ্ড। যখন হাই তুলেন তখন তাকে শাড়িপরা বাচ্চা হলহস্তির মতো দেখায়।
ডা. জোহরা খানম কয়েকটা কার্ড নিয়ে বসেছেন। কার্ডগুলিতে নানান ধরনের আঁকিবুকি কাটা। পেশেন্ট এইসব কার্ডের দিকে কিছুক্ষণ তাকাবে। তাকানোর পর কার্ডে কী আঁকা আছে বলে তার ধারণা তা সে বলবে। সেখান থেকে সাইকিয়াট্রিস্ট পেশেন্টের মানসিক অবস্থা সম্পর্কে একটা ধারণা করবেন।
আবু করিম সাহেব।
জি।
ভালো আছেন?
জি।
আমি খুব সাধারণ একটা সাইকোলজিকেল টেস্ট দিয়ে শুরু করব। এই টেস্ট সম্পর্কে আপনি খুব ভালো জানেন। এই কার্ডটার দিকে তাকান। কার্ডে অস্পষ্ট কিছু ছবি আঁকা আছে। এই ছবিটা দেখে আপনার কী মনে হচ্ছে? ছবিতে কী আঁকা?
আবু করিম দীর্ঘ সময় ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, চালতার আচার। ছোবা ছোবা হয়ে আছে। জ্বাল কম হয়েছে।
এখন বলুন এই ছবিটা কিসের?
আমের মিষ্টি আচার। কাশ্মিরী আচার নাম। যদিও এই ধরনের আচার কাশ্মিরে কখনো বানানো হয় না।
এখন এই ছবিটা দেখুন, এইটাও কি আচারের ছবি?
জি-না।
এটা কিসের ছবি?
হমড়ুর ছবি। হমডুর হাতে এক বোতল আমিষ আচার। তবে সে আমার সব খেয়ে শেষ করে ফেলেছে। মজা পেয়েছে। মুখভর্তি হাসি।
হমড়ু কে?
হমড়ু হলো সানাউল্লাহর পোষা ভূতের বাচ্চা। সানাউল্লাহর সঙ্গেই থাকে।
সানাউল্লাহ সাহেব কি আপনার বন্ধু?
জি।
আচ্ছা কল্পনা করুন–আপনি, আপনার স্ত্রী এবং সানাউল্লাহ সাহেব একটা নৌকায় করে যাচ্ছেন। আপনি একা সাঁতার জানেন, বাকি দুজন জানে না। হঠাৎ নৌকাড়ুবি হলো। আপনি যে-কোনো একজনকে বাঁচাতে পারেন। কাকে বাঁচাবেন?
নৌকায় কি কোনো আচারের বোতল আছে?
না।
সানাউল্লাহর সঙ্গে কি হমড়ু আছে?
না।
আবু করিম বললেন, আমি কাউকে বাঁচাব না। কারণ আমি সাঁতার জানি না। তবে আমার বন্ধু সানাউল্লাহ আমাকে বাঁচাবে। সে সাঁতার জানে এবং তার মাথা খারাপ হলেও সে লোক ভালো।
মাথা খারাপ বলছেন কেন?
যে ভূত পালে তাকে আপনি মাথা খারাপ বলবেন না?
ডা, জোহরা খানম বেশকিছু পরীক্ষা করলেন। এবং এক পর্যায়ে শায়লাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন— আপনার স্বামীর অবস্থা যথেষ্টই খারাপ। এখনো ভায়োলেন্ট হয় নি, তবে ভায়োলেন্ট হবার সব লক্ষণ পুরোদমে আছে। তাকে ঘরে আটকে রাখতে হবে। কখনোই বের হতে দেয়া যাবে না। নিয়মিত ওষুধ খাওয়াতে হবে। বেশির ভাগ সিডেটিভ। আমার একটা ক্লিনিক আছে। নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন— Hope, আমি সাজেস্ট করব এই মুহূর্তেই ক্লিনিকে ভর্তি করে দেয়া। কেবিন রুম আছে। এসি আছে। কষ্ট হবে না। এক মাস কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে পারবে না। বাইরে থেকে কোনো খাবার আসবে না। খাবার আমরা দেব। খরচ কিন্তু বেশি পড়বে আগেই বলে দিচ্ছি।