বলো কী?
জি। ম্যাডাম সবসময় এই কথা বলেন। তাছাড়া ম্যাডামের মন মেজাজ এখন। খুব খারাপ। সন্ত্রাসীরা তার চেম্বারে হামলা করেছিল। কাগজে উঠেছে, পড়েছেন
নিশ্চয়ই। স্যার, আমি যাই?
রাত অনেক হয়েছে। রফিক হিন্দি ছবি দেখছে। রফিকের পেছনে গা ঘেঁসে বসেছে হমড়ু এবং ডমরু। এরা দেহধারণ করে নি বলে রফিক তাদের দেখতে পাচ্ছে না। সানাউল্লাহ ভূতের লেখা নিয়ে বসেছেন। আজকের রচনার বিষয়—
ভূতের ভাষা। তিনি লিখছেন—
ভূতদের নিজস্ব ভাষা আছে। ব্যাকরণ আছে। তবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, তাদের নিজেদের কোনো বর্ণমালা নেই। পৃথিবীর আদিবাসী মানবগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের মিল লক্ষণীয়। অনেক আদিবাসীদের ভাষা আছে, কিন্তু বর্ণমালা নেই। যেমন, আন্দামানের নিকবর দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসী… জারোয়া, সেন্তেলিজ।
ভূত-বিষয়ক রচনা
ডঃ আইনুদ্দিন গভীর মনোযোগে সানাউল্লাহর ভূত-বিষয়ক রচনা পড়ছেন। মাঝে মাঝে তার ভুরু কুঁচকে যাচ্ছে। লেখা পড়ে বিরক্ত হচ্ছেন বলে যে এই ঘটনা ঘটেছে তা-না। তাঁর মন আজ অস্বাভাবিক খারাপ। স্ত্রীর সঙ্গে নাশতার টেবিলে একটা সমস্যা হয়েছে। নাশতার টেবিলে কেউ নিঃশব্দে নাশতা খায় না। দুএকটা কথা বলা ভুদ্রতারই অংশ। সেই হিসেবেই তিনি বললেন, একটা বিড়ালের গল্প শুনবে?
তাঁর স্ত্রী রুবা বলল, শুনব।
তিনি বললেন, অতি বিখ্যাত এক বিড়াল।
রুবা বলল, কী রকম বিখ্যাত? কথা বলতে পারে?
তিনি বললেন, কথা বলতে পারে না। সাধারণ বিড়াল। তবে এই বিড়াল একই সঙ্গে জীবিত ও মৃত।
রুবা বলল, সেটা কীভাবে সম্ভব?
তিনি বললেন, কোয়ান্টাম বলবিদ্যা এটাকে সম্ভব করেছে। দাড়াও বুঝিয়ে বলছি। মনে কর আমি সেই বিড়াল। আমার প্লেটে যে ডিমের পোচটা আছে এটা ডিমের পোচ না। এটা হলো একটা রেডিও অ্যাকটিভ বস্তু। এবং তুমি হলে একজন অবজার্ভার। খুবই বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, কোয়ান্টাম বলবিদ্যা অবজার্ভার নির্ভর। তুমি তাকিয়ে থাক বিড়ালটার দিকে। তোমার কী মনে হয়— আমি জীবিত না মৃত? এই বলেই তিনি কয়েকবার ম্যাও ম্যাও করলেন।
রুবা নাশতার টেবিল থেকে উঠে গেল। ব্যাগ গুছিয়ে গাড়ি নিয়ে মায়ের বাড়ি চলে গেল। আইনুদ্দিন বিখ্যাত থট এক্সপেরিমেন্টটা ব্যাখ্যা করার সুযোগই পেলেন না। ঘটনা এখানেই শেষ না। ঘণ্টা দুই পরে তিনি তার শাশুড়ির টেলিফোন পেলেন। আইনুদ্দিনের শাশুড়ি সালেহা বেগম একসময় বাংলা কলেজের ভাইস প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন। তাঁকে প্রমোশন না দিয়ে তাঁর জুনিয়র একজনকে প্রিন্সিপ্যাল করায় তিনি প্রতিবাদ হিসেবে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। নিজের বাড়িতে প্রিন্সিপ্যাল ভাব এখন তাঁর অনেক বেশি। তিনি গম্ভীর গলায় গালি দেবার মতো করে বললেন, কেমন আছ বাবা?
জি ভালো।
তুমি কি আজ নাশতা খেতে বসে বিড়ালের মতো ম্যাঁও ম্যাঁও করছিলে?
জি।
কেন করছিলে জানতে পারি?
আম্মা! নাশতার টেবিলে আমি কিছুক্ষণের জন্যে মানুষ ছিলাম না। আমি হয়ে গিয়েছিলাম শ্রোডিনজারের বিড়াল। যে জীবিতও না, আবার মৃতও না। অবজার্ভার ঠিক করবে সে জীবিত না-কি মৃত। আপনার মেয়ে রুবা ছিল অবজার্ভার। আম্মা, এখন কি আপনার কাছে পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়েছে?
পরিষ্কার হয় নি।
আরো খোলাসা করে বলি। এটা ছিল একটা থট এক্সপেরিমেন্ট। চিন্তা পরীক্ষা।
কী পরীক্ষা?
চিন্তা পরীক্ষা। পদার্থবিদ্যায় অনেক বিখ্যাত চিন্তা পরীক্ষা আছে। আপনাকে আরেকটা চিন্তা পরীক্ষার কথা বলি।
আমাকে কিছু বলতে হবে না বাবা। বরং তোমাকে আমি কিছু কথা বলি। তুমি ফিজিক্সের একটা মোটা বইয়ের ভেতর ঢুকে গেছ। সেই বই থেকে বের হতে পারছ না। আমার মেয়ে তোমার সঙ্গে জীবনযাপন করতে পারছে না, কারণ সে ফিজিক্স বা অংকের কোনো বই না। সে সাধারণ একজন মানুষ। বুঝতে পারছ?
পারছি।
আমার ধারণা বেশ কিছুদিন তোমাদের আলাদা থাকা উচিত।
জি আচ্ছা।
আমি তোমার সম্পর্কে ভালোমতো খোঁজখবর না নিয়ে তোমার সঙ্গে আমার বাচ্চা মেয়েটার বিয়ে দিয়ে মহা অন্যায় করেছি। তোমাদের বয়সের ব্যবধান বিশ বছর।
আইনুদ্দিন বললেন, আম্মা, আপনি ভুল করেছেন। ব্যবধান বিশ বছর না। উনিশ বছর পাঁচ মাস সাতদিন। আম্মা, কিছু মনে করবেন না। তথ্যগত ভুল আমার পছন্দ না।
সালেহা বেগম ‘প্রতিবন্ধি! ইডিয়েট!’ বলে টেলিফোন রেখে দিলেন।
আইনুদ্দিন শাশুড়ির বলা ইডিয়েট শব্দটায় কষ্ট পাচ্ছেন না। প্রতিবন্ধি শব্দটায় কষ্ট পাচ্ছেন। কারণ আর বাবা তাঁকে স্কুলে ভর্তি করাবার সময় হেডমাস্টার সাহেবকে বলেছিলেন, স্যার, আমার ছেলেটাকে একটু দেখেশুনে রাখবেন। সে মানসিক প্রতিবন্ধি। তাঁর বাবা সেই বছরেই মারা গেলেন। তিনি দেখে যেতে পারলেন না তাঁর ছেলে প্রতিটা প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি ফুল প্রফেসর বানিয়ে তাঁকে রেখে দেবার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েছিল, তিনি থাকেন নি। দেশে ফিরে এসেছেন। তাঁর দেশে ফেরার কারণও বিচিত্র। বর্ষাকালে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ আর ব্যাঙের ডাক না শুনলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিদেশে এই জিনিষ সম্ভব নয়।
আইনুদ্দিন ভুত বিষয়ক লেখা পড়ে শেষ করে বললেন, হুঁ।
সানাউল্লাহ বললেন, হুঁ মানে কী?
আইনুদ্দিন বললেন, ইন্টারেস্টিং লেখা।
সানাউল্লাহ বললেন, ভূত আছে এটা কি সায়েন্স দিয়ে প্রমাণ করা সম্ভব?
আইনুদ্দিন বললেন, থট এক্সপেরিমেন্ট করে দেখা যেতে পারে।