সানাউল্লাহ দুটা বর্ণমালার বই কিনলেন। ভূতছানাদের বর্ণমালা শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা। শিক্ষার ব্যাপারে ভূতরা কতটুকু আগ্রহী তিনি জানেন না। ওদের শেখাতে হবে কায়দা করে। তিনি রফিককে শেখাবেন, তাই দেখে দেখে ওরাও শিখবে। অনেকটা ঝি মেরে বৌকে শেখানো টাইপ।
তিনি নিজের জন্যে তিনশ পাতার চামড়ায় বাঁধানো খাতা এবং একডজন বলপয়েন্ট কিনলেন। ভূত বিষয়ক গ্রন্থ লিখে শেষ করতে হবে। এডভান্স টাকা নেয়া হয়ে গেছে। এখন আর কাজ ফেলে রাখা ঠিক না। দৈনিক দশপাড়া করে লিখলেও তিনশ পাতা লিখতে ত্রিশ দিন লাগবে। এক মাসের ধাক্কা।
ক্লিনিকে হামিদ আধামরার মতো পড়ে আছেন। তাঁকে স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। হামিদের দুজন ক্যাডার প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে কামরার বাইরে বসা। দুনিয়ার আত্মীয়স্বজন যেন ভিড় না করে সেই ব্যবস্থা। যে রোগী দেখতে যাবে সে ঘড়ি ধরে দুমিনিট থাকবে। দুমিনিটের বেশি কেউ থাকলে তাকে ঘাড় ধরে বের করে দেয়া হবে।
ক্যাডারদের একজনের চেহারা বাঁদরের মতো। কথাবার্তাও বাদরের মতো কিচকিচ করে বলে। সে বলল, স্যার হাতে ঘড়ি আছে?
সানাউল্লাহ বললেন, না।
অসুবিধা নাই। আমাদের সঙ্গে ঘড়ি আছে। দুই মিনিট টাইম। আমরা আউট বললেই দ্রুত বের হবেন। ওস্তাদের অবস্থা খুবই খারাপ। তাকে বিরক্ত করা ডাক্তারের নিষেধ আছে। ওস্তাদ কাউকে চিনতে পারছেন না। আপনাকেও চিনতে পারবেন না। নিজের পরিচয় দেবার জন্যে ব্যস্ত হবেন না। বুঝেছেন?
জি।
যান চুকে যান।
সানাউল্লাহ ঢুকে পড়লেন। হামিদ বিছানায় শোয়া। সানাউল্লাহকে দেখে মাথা তুললেন। সানাউল্লাহ বললেন, আপনার জন্যে মেড ইন আমেরিকা ব্যাটারি নিয়ে এসেছি।
হামিদ বললেন, এখন খাব? সেটা আপনার বিবেচনা। আমাকে কি চিনেছেন?
না। তবে তোমার পিতার নাম জানি— বাবা আদম। হয়েছে?
জি হয়েছে।
একটা ব্যাটারির খোসা খুলে দাও। খেয়ে ফেলি। ডাক্তাররা দেখলে খেতে দেবে না। ভালো কথা, ড্রেট অব এক্সপীয়রি দেখে এনেছ?
হ্যাঁ।
সানাউল্লাহ রোগীর পাশে রাখা ফলের প্লেট থেকে ছুরি নিয়ে অতি দ্রুত ব্যাটারির খোসা ছাড়িয়ে রোগীকে খাইয়ে দিলেন। হামিদ বললেন, এটার টেস্ট অনেক ভালো। আমেরিকা বলে কথা। একটা দেশ তো খামাখা এত বড় হয় না। কী বলো?
অবশ্যই।
ঐ ব্যাটারিটা আমার বালিশের নিচে রেখে দাও। সুযোগ বুঝে খেয়ে ফেলব।
সানাউল্লাহ বললেন, আমার একটা ছোট্ট কাজ করে দিতে হবে। একজনকে জনসমক্ষে চড় থাপ্পর দিতে হবে। কানে ধরে ঘুরতে হবে।
হামিদ বললেন, কোনো ব্যাপারই না। তার নাম। কোথায় থাকে। কখন পাওয়া যাবে সব লিখে ব্যাটারির সঙ্গে আমার বালিশের নিচে রেখে যাও। তোমার নাম এখন মনে পড়েছে। তুমি জাবিন মার বাবা। তোমার নাম সানাউল্লাহ। আমেরিকান ব্যাটারির গুণ দেখেছ? খাওয়ামাত্র অ্যাকশন।
সানাউল্লাহ নাম ঠিকানা লেখে বালিশের নিচে রাখলেন।
বাইরে থেকে বান্দরটা বলল, স্যার আউট। দুই মিনিটের বেশি হয়ে গেছে।
সানাউল্লাহ দ্রুত বের হয়ে এলেন।
রাত দশটা। ভিসিডিতে ছবি চলছে। ছবির নাম গজনি। বিরাট মারামারি কাটাকাটি। রফিক হা করে দেখছে। রফিকের পাশেই হুমড়ু ডমরু। রফিক এই দুই ভাইবোনকে দেখতে পাচ্ছে না। তবে সানাউল্লাহ দেখতে পাচ্ছেন। ছবির দিকে সানাউল্লাহর কোনো নজর নেই। তিনি খাতা নিয়ে বসেছেন। প্রথম পাতায় বড় বড় করে লিখলেন—
সানাউল্লাহ প্রণীত
দিনের শেষে ভূতের দেশে
ভূত বিষয়ক যাবতীয় তথ্যের প্রামাণ্য সংকলন
ক্রমাগত টেলিফোন বাজছে। নিশ্চয়ই জাবিনের টেলিফোন। তিনি টেলিফোন ধরলেন না। জরুরি লেখা নিয়ে বসেছেন। এখন কথা চালাচালির সময় না। টেলিফোন বেজেই যাচ্ছে। তিনি মহাবিরক্ত হয়ে সেট হাতে নিলেন।
বাবা, রাতে তোমার টেলিফোন করার কথা। তুমি টেলিফোন কর নি।
মারে, অসম্ভব ব্যস্ত। এত ব্যস্ত যে মাঝে মাঝে নিঃশ্বাস ফেলতেও ভুলে যাচ্ছি।
কী নিয়ে ব্যস্ত?
ভূতদের নিয়ে একটা গবেষণামূলক বই লিখছি। বইয়ের প্রকাশকও ঠিক হয়ে গেছে— মনোয়ারা পাবলিকেশন হাউস। মনোয়ারা হচ্ছে প্রকাশক কাদের সাহেবের স্ত্রী। বৎসর দুই আগে ভদ্রমহিলা মারা গেছেন। কাদের সাহেব স্ত্রীভক্ত মানুষ তো। তিনি স্ত্রীর নামে পাবলিকেশনের নাম দিয়েছেন। আগে নাম ছিল— স্বাধীন পাবলিকেশন লিমিটেড।
জাবিন বলল, হড়বড় করে এসব কী বলছ? আগে তো তুমি এত কথা বলতে। তোমার সমস্যা কী?
সানাউল্লাহ বললেন, লেখকদের যে সমস্যা আমারও একই সমস্যা। মাথার ভেতর লেখা ঘুরপাক খাচ্ছে তো। এই কারণে কী বলছি, কতক্ষণ ধরে বলছি তা অবান্তর হয়ে দাঁড়ায়। আমার বইটার নাম দিয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এটা একটা আশার কথা।
রবীন্দ্রনাথ কীভাবে নাম দেবেন? তিনি কি বেঁচে আছেন না-কি?
সানাউল্লাহ বললেন, তাঁর মতো মহাপুরুষদের মৃত্যু নেইরে মা। যে কারণে তিনি নিজেই নিজের মৃত্যু সম্পর্কে বলেছেন এনেছিলে সাথে তুমি মৃত্যুহীন প্রাণ। মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।
জাবিন বলল, বাবা, তুমি তোমার জামাইয়ের সঙ্গে কথা বলো। আমি তোমার কোনো কথাই বুঝতে পারছি না। নাও ধর।
সানাউল্লাহ অস্বস্তির সঙ্গে টেলিফোন ধরলেন। জাবিনের বরকে তিনি সামান্য ভয় পান। শ্বশুর হয়ে জামাইকে ভয় পাওয়া অত্যন্ত হাস্যকর ব্যাপার। মানবজীবন হলো হাস্যকর ঘটনাবলীর সমষ্টি।
বাবা, কেমন আছেন?