আসিফ সহজ স্বরে বলল, আমার ভাল লাগে না বাবা।
সিরাজুদ্দিন সাহেব থেমে থেমে বললেন, আজ আর কাল এই দু’দিন পড়তে হবে না। বিশ্রাম কর। মাঝে মাঝে বিশ্রামের প্রয়োজন আছে।
বিশ্রাম না বাবা। আমি আর পড়াশোনাই করব না।
টান দিয়ে কান ছিঁড়ে ফেলব হারামজাদা।
কান ছিঁড়ে ফেললেও পড়ব না।
সিরাজুদিন সাহেব অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
তখন তাঁর তৃতীয় মেয়ের বিয়ের আয়োজন চলছে। বাড়ি ভর্তি মেহমান। কিছু বলা বা শাসন করার মত মানসিক অবস্থা তার নেই। তিনি অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে গেলেন। আসিফের মা চির রুগ্না মহিলা। সংসারের কোনো ব্যাপারেই তার কোনো ভূমিকা নেই। তবু তিনি ক্ষীণ স্বরে বললেন, বাদ দাও। কয়েকটা দিন যাক। ছেলে মানুষ বয়সটা দেখবে না?
সিরাজুদিন অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন আসিফ পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে। সকালবেলা বের হয়। সারাদিন কোথায় কোথায় ঘোরে। সন্টার ড্রামাটিক ক্লাবে নাটকেও নাকি নাম-দিয়েছে। রাত আটটা নটা পর্যন্ত রিহার্সেল হয়। বিহার্সেল শেষ করে সে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বাড়ি ফেরে। সিরাজুদ্দিন সাহেব ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন। আর হতভম্ব হয়ে ভাবেন এসব কি হচ্ছে? হচ্ছেটা কি?
স্টার ড্রামাটিকে ক্লাবের এ্যানুয়েল নাটক হল জেলা স্কুলের মাঠে। বিরাট হৈচৈ। সিরাজুদ্দিন সাহেব নাটক দেখতে গেলেন। ত্রিপুরা রাজপরিবার নিয়ে জমকালো নাটক। তিন রাজকুমারের গল্প। বড় রাজকুমার, মধ্যম রাজকুমার এবং ছোট রাজকুমার। বড় এবং ছোট রাজকুমারের অত্যাচারে মধ্যম রাজকুমার জর্জরিত। এক’দিন তার দুচোখ নষ্ট করে দিয়ে দুই ভাই তাকে গভীর বনে ফেলে দিয়ে এল। ক্লান্ত শ্ৰান্ত মধ্যম রাজকুমার যে দিকে যেতে চায় গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায়। কোনোমতে উঠে দাঁড়ায়, আবার ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায় এবং কাঁদতে কাঁদতে বলে, কে কোথায় আছ? বন্ধু হও, শত্রু হও কাছে এস ভাই। দৃষ্টিহীন, ভাগ্যহীন, আত্মীয় বান্ধবহীন মধ্যম কুমার আজ পথের ধূলায়।
মধ্যম রাজকুমারের অভিনয় দেখে সিরাজুদ্দিন সাহেব অভিভূত হয়ে পড়লেন। তার চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি পড়তে লাগল। বুকের মধ্যে হুঁ হুঁ করতে লাগল। চারদিকে প্রচণ্ড হাততালি পড়ছে। সেই শব্দ ছাপিয়ে তাঁর কানে বাজছে মধ্যমকুমারের হাহাকার কে কোথায় আছ? বন্ধু হও, শত্রু হও কাছে এস ভাই। দৃষ্টিহীন, ভাগ্যহীন, আত্মীয় বান্ধবহীন, মধ্যম কুমার আজ পথের ধূলায়।
গলায় একটা রুপার মেডেল ঝুলিয়ে আসিফ বাড়ি ফিরল। সিরাজুদিন সাহেব আগেই পৌঁছেছেন। একা একা অন্ধকার বারান্দার জায়নামাজে বসে আছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে গভীর চিন্তায় তিনি মগ্ন। আসিফ ঘরে ঢুকতেই তাঁর আচ্ছান্ন ভাব দূর হল। শান্ত গলায় বললেন, আয় আমার সাথে।
ছেলেকে তিনি বাসার পেছনের কুয়োতলায় নিয়ে গেলেন। সহজ গলায় বললেন, গলার মেডেলটা খুলে কুয়ার মধ্যে ফেল।
তার কণ্ঠে এমন কিছু ছিল যে আসিফ কোনো কথা না বলে মেডেল ফেলে দিল। গহীন কুয়া। মনে হল যেন দীর্ঘ সময় পর পানিতে ঝাপ করে শব্দ হল।
সিরাজুদিন সাহেব বললেন, এখন বল, আর কোনোদিন অভিনয় করব না। বল, বল হারামজাদা।
আসিফ কিছু বলল না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সিরাজুদ্দিন সাহেব বললেন, বল, আর কোনোদিন অভিনয় করব না। নয়ত তোকে আজ খুন করে ফেলব। বল, হারামজাদা। বল।
আসিফ ক্ষীণ গলায় বলল, কেন বাবা?
বল তুই। বল। নয়ত খুন করে ফেলব।
সিরাজুদিন সাহেবের চোখে-মুখে উন্মাদ ভঙ্গি। তিনি ছেলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। দুহাতে চুলের মুঠি ধরে মাথা ঝাকাতে ঝাকাতে বললেন, বল আর অভিনয় করব না। বল।
আসিফ যন্ত্রের মত বলল, আর অভিনয় করব না।
সিরাজুদ্দিন সাহেব ছেলের মাথা কুয়ার মুখের কাছে ধরলেন। হিসহিস করে বললেন, রল, আবার বল। তিন বার বল।
আসিফ বলল। গহীন কুয়া সেই শব্দ ফেরত পাঠাল। কুয়ার তল থেকে গমগমে অথচ শীতল একটি স্বর ফিরে এল। আমি অভিনয় করব না. অভিনয় করব না। করব না।
আসিফ তার কথা রেখেছিল। বাবা জীবিত থাকাকালীন সময়ে সে অভিনয় করেনি। তার জীবনের দ্বিতীয় অভিনয় সে করে বাবার মৃত্যুর এক বছর পর। গ্ৰাম্য কবিয়ালের একটা ভূমিকা। যে কথায় কথায় পদ বাঁধে। সেই পদ লোকজনদের বলে বলে শোনায় এবং গভীর আগ্রহে বলে, পদটা কেমন হইছে ভাইজান এটু কন দেহি। বুকের মইধ্যে গিয়া ধরে, ঠিক না? আহারে কি পদ বানিছি
হলুদ পাখি সোনার বরণ কালা তাহার চউখ,
ছোট্ট একটা পাখির ভিতরে কত্ত বড় দুঃখ
ও আমার সোনা পাখিরে। ও আমার ময়না পাখিরে।
গ্ৰাম্য গীতিকারের অভিনয় করে সে ময়মনসিংহ শহরে একটা হৈচৈ ফেলে দিল। অভিনয়ের শেষে স্টেজের পেছনে গ্লাসে করে চা খাচ্ছে, জেলা স্কুলের হেড মাস্টার সাহেব ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঢুকে বললেন, আসিফ একটু বাইরে আস তো, ডিসট্রিক জাজ ওয়াদুদুর রহমান সাহেব তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান।
চা-টা শেষ করে আসি স্যার।
চা পরে খাবে আসি তো তুমি।
আসিফ বাইরে এসে দেখে ওয়াদুদুর রহমান সাহেব হাতে চুরুট নিয়ে বিমর্ষ ভঙ্গিতে টানছেন। তাঁর গা ঘেঁষে লম্বা রোগামতন একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। মেয়েটির মুখে দীঘির শীতল জলের মত ঠাণ্ডা একটা ভাব। মেয়েটি কিছু বলল না। ওয়াদুদুর রহমান সাহেব বললেন, ইয়াং ম্যান, তোমার অভিনয় দেখে আমার মেয়ে খুব ইমপ্রেসড। ওয়েল ডান।
আসিফ কি বলবে বুঝতে পারল না। ওয়াদুদুর রহমান সাহেব বললেন, আমার মেয়ের খুব ইচ্ছা তুমি এক’দিন আমাদের বাসায় এসে লাঞ্চ বা ডিনার কর। আমি নিজেও খুশি হব।