পাশের ঘরে এখনো ভিসিপি চলছে। এরা কি সত্যি সত্যি সারা রাত ছবি দেখবে নাকি। হাশমত আর বেনু দুজনেই খুব হাসছে। এ রকম হাসাহাসির মধ্যে বাচ্চা ঘুমুবে কি করে? এই সহজ জিনিসটা বোঝে না কেন?
লীনা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। তার লোপার কথা মনে পড়ছে। কেমন থপথপ করে হাটত। চলন্ত কোনো পোকা-টোকা দেখলেই খপ করে ধরে মুখে পুরে ফেলত। সেই মুখ তখন কিছুতেই হাঁ করান যেত না। যেন পৃথিবীর সবচে লোভনীয় খাবারটি তার মুখে। এক বছর বযসে কত কথা শিখে গেল। কিছু কিছু কথার আবার কোনো অর্থই নেই। যেমন ইরি কিরি মিরি মিরি।
লীনা বলত, এসব কোন পৃথিবীর ভাষা মা?
লোপা তাতে আরো মজা পেত। হাত নেড়ে নেড়ে আরো অনেক উৎসাহ নিয়ে বলত, ইরি, কিরি, মিরি মিরি।
লীনার চোখ জ্বালা করছে। সে বিছানায় উঠে বসল। কী করা যায়? কী করলে এই মেয়েটার কথা ভুলে থাকা যায়? লোপা-ত্রপা এদের কথা সে কিছুতেই মনে করতে চায় না। কিছুতেই না।
পাশের ঘরে খুকি। কাঁদছে। বেনুর বিরক্ত গলা শোনা যাচ্ছে। লীনা কী উঠে গিয়ে ওদের দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলবে, বেনু, ওকে আমার কাছে দিয়ে যাও।
নাকি চুপচাপ বিছানায় বসে থাকবে।
একা একা বসে থাকতে
একা একা বসে থাকতে আসিফের কখনো খারাপ লাগে না।
আজ লাগছে। সোফাটায় কোনো ঝামেলা আছে কিনা কে জানে। কোনোভাবে বসেই আরাম পাওয়া যাচ্ছে না। সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে খাওয়া যাচ্ছে না। সাইন বোর্ড ঝুলছে–ধূমপান সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। চোখের সামনে এ রকম কড়া একটা সাইন বোর্ড নিয়ে সিগারেট ধরান যায় না। তা ছাড়া ঘরে ফিনাইলেন গন্ধ। এইগন্ধ নাকে এলেই কেমন যেন নিজেকে অসুস্থ মনে হয়।
আসিফ ঘড়ি দেখল, বারটা দশ। যে অপারেশন এগারোটায় হবার কথা সেটা এখন হবে রাত
একটায়। এনেসথেসিস্ট পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি নাকি কোন বিয়ে বাড়িতে গেছেন, বলে গেছেন বারোটার দিকে ফিরবেন। সেইভাবেই ব্যবস্থা হয়েছে। আসিফের বড় বোন রেহানা খুব ছটফট করছেন। একবার তিন তলায় যাচ্ছেন আবার আসছেন এক তলায়। এই ক্লিনিকটা বেশ ভাল। লিফট আছে। মাঝরাতেও লিফটম্যান আছে। রেহানা লিফটে উঠছেন না। সিঁড়ি ভেঙে ওঠা-নামা করছেন। রেহানার শরীর বিশাল, কিন্তু তাতেও তেমন অসুবিধা হচ্ছে না। শুধু মুখ টকটকে লাল হয়ে আছে এবং তিনি খুব ঘামছেন।
আসিফ বলল, তুমি শান্ত হয়ে বস তো আপা। এ রকম করছি কেন?
এনেসথেসিস্ট তো এখনও এল না। অন্য কোনো ক্লিনিকে নিয়ে যাব?
এসে পড়বেন। তুমি শুধু শুধু ব্যস্ত হচ্ছি। বস আমার পাশে। তোমার নিজের হার্ট এ্যাটাক হয়ে যাবে।
রেহানা বসলেন না। ছটফটিয়ে আবার তিন তলায় রওনা হলেন। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এনেসথিসিস্ট এসে পড়ল। এক ধরনের টেনশান আসিফের মধ্যেও ছিল। এখন আর তা নেই। আশ্চর্যের ব্যাপার, সোফায় বসতেও তার আরাম লাগতে শুরু করেছে। ঘুম-ঘুমাও পাচ্ছে। এ ভাবে বসে থাকলে ঘুম এসে যেতে পারে। আসিফ বারান্দায এসে দাঁড়াল। সিগারেট ধরাবার ইচ্ছে করছে, ধরানো যাচ্ছে না। চারদিকে আত্মীয়স্বজন। ঢাকা শহরে যেখানে যে ছিল সবাই চলে এসেছে। ক্লিনিকের সামনে ছ’সাতটা গাড়ি।
আসিফদের পাঁচ বোনের চার জনই থাকে ঢাকাতে। তারা সবাই এসেছে। তাদের আত্মীয়স্বজনরা এসেছে। হুঁলস্থূল ব্যাপার। এদের প্রায় কাউকেই সে ভালমত চেনে না। কয়েকবার হয়ত দেখা হয়েছে, কি কেমন? ভাল? এই জাতীয় কথাবার্তা হয়েছে। এর বেশি কিছু না। বোনদের স্বামীর বাড়ির লোকজনদের সে যেমন চেনে না, ওরাও চেনে না। তবু কয়েকজন চকচকে চেহারার মানুষ আসিফকে বলল, কি, ভালো?
আসিফ খুবই পরিচিত ভঙ্গিতে হোসেছে। কথাবার্তা পর্ব এই পর্যন্তই।
এটা খাবুই আশ্চর্যের ব্যাপার যে গার্লস হাই স্কুলের একজন দরিদ্র এ্যাসিস্টেন্ট হেড মাস্টার তার পাঁচ মেয়েকেই খুব ভাল বিয়ে দিয়েছেন, অথচ মেয়েগুলি পড়াশোনা বা দেখতে শুনতে এমন কিছু না। আসিফ তার বাবা মার পাঁচ কন্যাব পরেব সন্তান। শুধুমাত্র এই কারণেই যতটুকু আদর তার পাওযা উচিত ছিল তার শতাংশও সে পাযনি। আসিফের বাবা সিরাজুদিন সাহেব তার সর্বশেষ সন্তানকে কঠিন হাতে মানুষ করতে শুরু করলেন। তাঁর এই ছেলে যে হীরেব টুকরো ছেলে এটা তিনি সবাইকে দেখিয়ে দিতে চান। অন্য বাচ্চাবা যখন এক দুই শিখছে, তখন তাঁর ছেলে শিখছে তিনের ঘরের নামতা। ক্লাস টুতে উঠেই সে রবীন্দ্রনাথের বীরপুরুষ কবিতা গোটাটা মুখস্থ বলে লোকজনদের চমকে দিতে শিখে গেল। সিবাজুদিন সাহেবও পুত্রের প্রতিভায় মুগ্ধ। বাড়িতে কেউ এলে আসিফকে তার প্রতিভার পরীক্ষা দিতে হয়। বীবপুরুষ কবিতা মুখস্থ বলবার পর সিরাজুদিন সাহেব নিজেই বলেন, আচ্ছা বাবা, তিন আঠারো কত বল তো?
আসিফ গম্ভীর গলায় বলে, চুয়ান্ন। অতিথি চমকে উঠে বলেন, আঠারোর ঘরের নামতা জানে নাকি! সিরাজুদিন সাহেব উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বলেন, ইংরেজি জিজ্ঞেস করেন। বানান জিজ্ঞেস করেন। আচ্ছা বাবা, জিবাফ বানানটা কি বল তো?
আসিফ বানান বলে। অতিথি যত না চমৎকৃত হন, বাবা হন তারচে বেশি। গম্ভীর গলায় বলেন, সবই হচ্ছে ট্রেনিং। যত্ন নিতে হয়। প্রপার গাইডেন্স দরকার।
ক্লাস এইট পর্যন্ত আসিফ প্রতিটি পরীক্ষায় ফাস্ট হল। তারপর এক’দিন খুবই স্বাভাবিক গলায় বাবাকে এসে বলল, আমি আর পড়াশোনা করব না বাবা। সিরাজুদিন সাহেব হতভম্ব হয়ে বললেন, সে কি!