তুমিও তো অনেক কাজ কর। ঘরের সব কাজ সামলাও, বাচ্চা দেখ। বাচ্চা কী ঘুমিয়ে পড়েছে?
জি। অনেক কষ্টে ঘুম পাড়াইছি। এরে একটা তাবিজ-টাবিজ দিতে হইব ভাবী।
তুমি কোলে নিয়ে নিয়ে মেয়েটাকে নষ্ট করেছ বেনু।
তাও ঠিক।
বেনু তৃপ্তির হাসি হাসল। যেন সে মেয়েকে নষ্ট করায় খুব আনন্দিত। সব মায়েরা যা পারে না সে তা পেরেছে।
ভাবী।
বল।
বেনু ইতস্তত করে বলল, একটা শরমের কথা ভাবী। খুঁকির আব্বা কেমুন একটা ছবি আনছে। অসভ্য কাণ্ডকারখানা। দেখলে শইল বিম-ঝিম করে।
না দেখলেই হয়।
আমি খুকির আব্বারে বলছি–এই ছবি দেখলে পাপ হইব। সে খালি হাসে। এইসব ক্যামনে বানায় আফা?
জানি না বেনু।
লীনাকে ছবি দেখার জন্যে বসতে হল। দিদার নামের কী একটা পুরনো সিনেমা হচ্ছে। হিন্দী প্রতিটি বাক্য হাশমত আলি অনুবাদ করে দিচ্ছে। খুব বিরক্তিকর ব্যাপার। প্রচণ্ড ঘুমে শরীর আচ্ছান্ন হয়ে আসছে।
ছবি মাঝপথে রেখে লীনা উঠে এল। আর আশ্চৰ্য, বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুম উধাও। লীনা অনেকক্ষণ এপাশি-ওপাশ করল। মাথায় পানি দিয়ে এল. লাভ হল না। এই রাতটাও সম্ভবত অঘুমে কাটাতে হবে। এ রকম হচ্ছে কেন? তার মনে কি কোনো গোপন দুঃখ আছে? কোনো হতাশা আছে? থাকার তো কথা নয়। তাহলে এ রকম হচ্ছে কেন?
বাবার অভিশাপ লাগল নাকি?
লীনার বাবা ডিস্ট্রিকট জাজ ওয়াদুদুর রহমান সত্যি সত্যি মেয়েকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। জাজ শ্রেণীর মানুষরা কখনো খুব বেশি রাগতে পারেন না। কিন্তু তিনি রেগে গিয়েছিলেন। রাগে অন্ধ হয়ে বলেছিলেন, কি আছে ঐ ছেলের? অভিনয় করে। অভিনয়টা আবার কি? অভিনয় হচ্ছে অনুকরণ। একটা বানরও অনুকরণ করে। তাই বলে একটা বানরকে বিয়ে করা যায়?
লীনা কাঁদতে কাঁদতে বলল, এসব তুমি কী বলছি বাবা?
ওয়াদুদুর রহমান সাহেব রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, যা বলেছি ঠিকই বলেছি। ঐ ছেলের আর আছে কী? ঘাড়ে-গর্দানে এক ছেলে। থার্ড ক্লাস পেয়েছে বি.এ.তে। ব্যাংকে চাকরি করে। ঐ চাকরির বেতন কত তুই জানিস? এগারোশ টাকা। এগারোশ টাকা দিয়ে ও নিজে খাবে, না তোকে খায়োবে? নাকি না খেয়ে থাকবে। আর অভিনয় করে দেখাবে যে খুব খাওয়া হল?
ছিঃ, বাবা, এই ভাবে কথা বল না।
আমার যা বলার। আমি বললাম। এখন তোর যা ইচ্ছা করবি। তোর স্বাধীন ইচ্ছায় আমি বাধা দেব না। তবে এই বাড়িতে বিয়ে হবে না। বিয়ের খরচ আমি দেব। সেই টাকা আলাদা করা।
তোমার টাকা আমার লাগবে না বাবা।
নাটকের লোক বিয়ে করার আগেই নাটকের সংলাপ শুরু করেছিস। জীবন নাটক না, এটা হাড়ে-হাড়ে টের পাবি। জীবন এক সময় অসহ্য বোধ হবে।
অভিশাপ দিচ্ছ?
সত্যি কথা বলছি। মাঝে মাঝে সত্যি কথা অভিশাপের মত মনে হয়।
লীনার বিয়ে হল বড় খালার বাড়িতে। সেই বিয়েতে ওয়াদুদুর রহমান সাহেব এলেন না। তবে লীনার ধারণা তার বাবার অভিশাপ লাগেনি। তারা সুখী। প্রচণ্ড সুখী। টাকা-পয়সার কষ্ট তো আছেই। এই কষ্ট তেমন কোনো কষ্ট নয়। সহনীয় কষ্ট। অসহনীয় কষ্ট হচ্ছে ভালবাসার অভাবের কষ্ট। সে কষ্ট লীনাদের হয়নি। লীনা এখনো তার স্বামীর প্রতি তীব্র ভালবাসা বোধ করে। ভালবাসা কখনো একপক্ষীয় হয় না। আসিফও নিশ্চয়ই তার প্রতি সমপরিমাণ ভালবাসা লালন করে। কিন্তু সত্যি কী করে?
লীনা উঠে পড়ল। আবার মাথায় কিছু পানি দিল। পাশের ঘরে ভিসিপি চলা ছ। যুগল সংগীত। সুর বেশ সুন্দর। কথাগুলির মানে কী কে জানে ও মেরা পানাছেরি।
পানাছেরি শব্দের মানে কি? হাশমত সাহেবকে কাল একবার জিজ্ঞেস করতে হবে। মনে থাকলে হয়। আজকাল কিছু মনে থাকে না।
বেনুর বাচ্চা জেগে উঠেছে। কাঁদছে ট্যাঁ ট্যাঁ করে। বেনু তাকে নিয়ে বারান্দায় হাঁটছে আর বলছে, ও খুকি। কান্দে না। ও খুকি কান্দে না।
কি বিশ্ৰী নাম–খুকি। এর পর যদি ছেলে হয় হয়ত নাম রাখবে খোকা।
লীনা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। তাদের প্রথম মেয়ের নাম সে রেখেছিল লোপামুদ্রা, পরের মেয়েটি নাম ত্ৰিপা। ওরা কোথায় গেল? মৃত্যুর পর শিশুরা কোথায় যায়? সেই দেশে একা একা ওরা কী করে? বাবা মার জন্যে অপেক্ষা করে কি? এক’দিন লীনা যখন যাবে ওরা কি তখন সেই ছোটটিই থাকবে না বড় হয়ে যাবে? যদি ছোট থাকে তাহলে কি চিনতে পারবে মাকে? মা মা বলে ছুটে আসবে তার দিকে? যদি ছুটে আসে তাহলে কাকে সে প্রথমে কোলে নেবে? লোপাকে না ত্রপাকে?
লীনার বুক জ্বালা করছে। সে দরজা খুলে বারান্দায এল। বেনু বলল ঘুমান নাই আফা?
না।
দেখেন না কী বিরক্ত করে। ইচ্ছে করতাছে একটা আছাড় দেই।
ছিঃ এসব কী কথা। দেখি আমার কাছে দাও তো।
বেনু তার মেয়েকে লীনার কাছে দিল। মেয়েটির কান্না থামল না। লীনা বলল, গরম লাগছে বোধ হয়, জামাটা খুলে দেব?
দেন।
মেয়ের তো খুব ঘামাচি হয়েছে। আমার ঘর থেকে পাউডার নিয়ে এস তো বেনু. পাউডার দিয়ে দিই।
গায়ে পাউডার দেয়াতে হয়ত একটু আরাম হয়েছে। খুকি। ঘুমিয়ে পড়েছে। হাত-পা ছড়িযে ঘুম। মেয়েটা দেখতে সুন্দর হয়নি। বাবার মত ভোতা ধরনের চেহারা। দাঁতগুলিও সম্ভবত উঁচু তবু কী সুন্দরই না লাগছে। মানব শিশুর মত সুন্দর এ পৃথিবীতে আর কিছুই বোধ হয় নেই।
লীনার খুব ইচ্ছে করছে বলে–বেনু, তোমার মেয়ে আজ থাকুক আমার এখানে। তা সে বলতে পারল না। সহজ গলায় খুব সাধারণভাবে যা বলল তা হচ্ছে, নিয়ে যাও বেনু ঘুমিযে পড়েছে।
বেনু তার মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল। লীনা ঠিক আগের ভঙ্গিতে খাটের উপর বসে আছে। পানি খেতে পারলে ভাল হত। বুক শুকিয়ে কাঠ, কিন্তু উঠতে ইচ্ছা করছে না।