লীনা বলল, বেশ তো যাবে যাও–ভাত খেয়ে যাও।
ভাত খাব না। একদম খিদে নেই। সম্ভাবেলা ভাজাতুজি কি সব খেয়েছি, টক চেকুর উঠছে। যাই
লীনা বেশ মন খারাপ করে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রইল। জরুরি কথাটা এখন তার মনে পড়েছে। চেঁচিয়ে ডাকবে আসিফকে? ডেকে বলবে জরুরি কথাটা? ডাকাটা কি ঠিক হবে? এখন মনে হচ্ছে কথাটা তেমন জরুরি নয়।
দোতলার ফ্ল্যাটটা
দোতলার ফ্ল্যাটটা লীনারা যাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে থাকছে, তাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা তিন। স্বামী স্ত্রী এবং তিন বছর বয়েসি একটি মেয়ে। একজন কাজের ছেলে আছে, সে বেশির ভাগ সময়ই ঘুমিয়ে কাটায়। পরিবারের কর্তা হাশমত আলি বেশ বয়স্ক লোক। চল্লিশের মতো বয়স। আগে একবার বিয়ে করেছিলেন। ঐ পক্ষের দু’টি মেয়ে আছে। মেয়েরা তাদের নানার বাড়িতে থাকে। নানার বাড়ি টঙ্গীতে। মাঝে মাঝে আসে, সারাদিন থেকে সন্ধ্যাবেলা চলে যায়। হাশমত সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রী বেনু। এই মেয়েটার বয়স খুবই কম। পনেরো-ষোল হওয়া বিচিত্র নয়। গ্রামের মেয়ে। তবে শহরে চাল-চলন দ্রুত আয়ত্ত করে ফেলেছে। মেয়েটি সুন্দরী, তাবে বাচ্চা হবার পর গাল-টাল ভেঙে গেছে। বাচ্চাটা মায়ের কোল ছাড়া থাকতেই পারে না। বেনুকে সারাদিন বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘুরতে হয়। লীনাকে সে খুবই পছন্দ করে। যতক্ষণ লীনা বাসায় থাকে বেনু তার পেছনে থাকে। ব্যাপারটা লীনার পছন্দ না হলেও কিছু বলে না। এই সাদাসিধা অল্প বয়েসী মেয়েটাকে লীনার ভালই লাগে। সেই তুলনায় হাশমত আলিকে তার একেবারেই ভাল লাগে না। লোকটার সব কিছু কেমন যেন গ্ৰাম্য। রেলের বাধা মাইনের চাকরিতেও তার রোজগার সন্দেহজনকভাবে ভাল। তবে তার ব্যবহার ভাল। গত মাসে সে একটা ফ্রিজ কিনেছে এবং লীনাকে বলেছে, কিছু এরিয়ার টাকা পেলাম, তারপর প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে লোন নিলাম, তারপর কিনে ফেললাম। একটা সখ ছিল ভাবী।
লীনা বলল, ভাল করেছেন।
এখন আরাম করে ঠাণ্ডা পানি খেতে পারবেন। হা হা হা। বেনু, ভাবীকে একটা পেপসি দাও।
এখন থাক।
না ভাবী খান। খেতে হবে। এটা ভাবী আপনি নিজের ফ্রিজ ভাববেন। রিকোয়েস্ট। বেনু শোন, নিচের একটা তাক ভাবীর। খবরদার কিছু রাখবে না। যদি দেখি তোমার কিছু আছে তাহলে অসুবিধা আছে। জিনিসটা কেমন কিনলাম ভাবী?
খুব ভাল। খুব সুন্দর।
অনেকগুলি টাকা চলে গেল, তবু সখের একটা জিনিস, তাই না ভাবী?
তা-তো বটেই।
হাশমত আলির মধ্যেও এক ধরনের সরলতা আছে। এটা লীনার ভাল লাগে।
এরা সুখেই আছে। নিজেদের নিয়ে আনন্দে আছে। পৃথিবী সমাজ-টমাজ এইসব নিয়ে বিন্দুমাত্রক মাথাব্যথা নেই। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিসে এরা গভীর আনন্দ খুঁজে পায়। প্রায়ই দেখা যায় অনেক রাত হাশমত আলি বড়-সড় একটা মাছ কিনে এনেছে। বেনু সেই মাছ কাটছে। হাশমত আলি উবু হয়ে তার সামনে বসে আছে। মাছটা কি রকম, সেই নিয়ে গবেষণা হচ্ছে।
পুকুরের মাছ, কি বল বেনু? রঙটা কেমন কালো দেখ না। শ্যাওলার নিচে থেকে কালো হয়ে গেছে। নদীর মাছ হলে লাল হত। তোলটা ঠিক আছে কি না দেখ তো।
ঠিক আছে।
তেল দিয়ে বড়া বানাতে পারবে। মাছের তেলের বড়া–তার স্বাদই অন্য রকম। দুটো বড় করে পিস কাট। ভেজে লীনা ভাবীদের দিয়ে এস।
ওরা বোধ হয় শুয়ে পড়েছে। সকালে দেব।
আরো না এখনই দাও। টাটকা জিনিসের একটা আলাদা ব্যাপার আছে।
গভীর রাতে প্লেটে ভাজা মাছ নিয়ে হাশমত আলি নিজেই দরজা ধাক্কায় ভাবী ঘুমিয়ে পড়লেন না কী? ও ভাবী, ভাবী।
পরিষ্কার বোঝা যায়। এই পরিবারটি লীনাদের বেশ পছন্দ করে। কেন করে সেও এক রহস্য। এতদিন একসঙ্গে আছে, এর মধ্যে এক’দিনও নাটক দেখার ব্যাপার কোনো আগ্রহ দেখায়নি। হাশমত আলি অবশ্যি প্রায়ই বলে, এক’দিন যাব। বুঝলেন ভাবী, আপনাদের কাণ্ড কারখানা দেখে আসব। মেয়েটাকে নিয়ে হয়েছে মুশকিল। সারাক্ষণ ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে। বাচ্চা নিয়ে কী যাওয়া যায় ভাবী? বেনুকে এক’দিন নিয়ে দেখাব। গ্রামের মেয়ে, কিছু তো এই জীবনে দেখেনি।
সিঁড়ির বাতি বোধ হয় আবার চুরি হয়েছে। খুব সাবধানে পা টিপে টিপে উঠতে হচ্ছে। একটা সিঁড়ি আছে ভাঙা। বাড়িওয়ালাকে কতবার বলা হয়েছে। এখনো কিছু করছে না।
দরজা খুলে দিল বেনু। অবাক হয়ে বলল, এত রাতে একা একা আসলেন ভাবী
না একা না। তোমার ভাই নামিয়ে দিয়ে গেছে।
ভাই আবার গেলেন কই?
তার এক ভাগ্নির অপারেশন।
ও আল্লা! কী হইছে?
কী হয়েছে লীনা নিজেও ভালমতো জানে না। জানা উচিত ছিল। কথাবার্তা শুনে হাশমত বেরিয়ে এল। হাসিমুখে বলল, একটা ভিসিপি ভাড়া করে নিয়ে এসেছি ভাবী।
তাই নাকি?
তিনশ টাকা দিয়ে এক সপ্তাহের জন্যে ভাড়া করলাম। মনের সখ মিটিয়ে ছবি দেখব।
ভালই তো।
খাওয়া-দাওয়া করে আসেন। একসঙ্গে দেখি–এগারোটা ছবি এনেছি। সব ভাল ভাল ছবি। আসিফ ভাই কই?
ওর এক ভাগ্নিকে দেখতে গেছে। ভোরবেলা আসবে।
আমি ভাবী দুদিনের দু’টি নিয়ে নিয়েছি। ক্যাজুয়েল লিভ। দিনরাত ছবি দেখব।
ভাল। দেখুন।
আপনি ভাত খেয়ে আসুন। একা একা ছবি দেখে সুখ নেই ভাবী।
প্লেটে ভাত নিয়ে লীনা শোবার ঘরে চলে এসেছে। লীনার পেছনে পেছনে ঢুকেছে বেনু। ভাত খাওয়া হলে জোর করে তাকে ছবি দেখাতে নিয়ে যাবে। লীনার চোেখ ঘুমে জড়িয়ে যাচ্ছে। তবু মনে হচ্ছে তাকে ছবি দেখতেই হবে।
ভাবী?
কী বেনু।
আপনি এত কাজ। সারাদিনে ক্যামনে করেন। তাই ভাবি। দিনে স্কুল। রাতে নাটক থিয়েটার।