আসিফ বলল, তোমার নাম কি?
পুষ্প ধরা গলায় বলল, আমার নাম দিয়ে আপনার কোনো দরকার নেই।
এটা সে কেন বলল কে জানে? লেখকের ওপর তার অসহ্য রাগ লাগছিল। এই রাগের জন্যেই হয়তো বলেছে। এখন আবার তার জন্যে খারাপ লাগছে।
হলঘরের ভেতর অসহ্য গরম।
বাইরে এসে একটু আরাম লাগছে। ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। লীনা হালকা গলায় বলল, বৃষ্টি হবে নাকি? আসিফ জবাব দিল না। মনে হচ্ছে সে অন্য কিছু ভাবছে।
লীনা বলল, কিছু ভাবছি নাকি?
না।
বড্ড পানির তৃষ্ণা পেয়েছে। ঠাণ্ডা কিছু খেলে কেমন হয়?
ভালই হয়।
তারা দু’জন কনফেকশনারি দোকানে ঢুকল। লীনার কি যে একটা বলার কথা, অথচ কিছুতেই মনে পড়ছে না। মাঝে মাঝে তার এ রকম হয়। খুব জরুরি কথা, যেটা না বললেই নয়–অথচ মনে পড়ে না।
লীলা।
কি?
টিভিতে একটা অফার পেয়েছি, যােব কি না বুঝতে পারছি না।
যাবে না কেন?
কখনো করিনি তো। বুঝিও না। তাছাড়া…।
তাছাড়া কি?
রোলটা খুব ছোট। নায়কের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। নায়কের কাছে দুবার টাকা ধার চাইতে আসে। এই পর্যন্তই। অভিনয়ের কোনো স্কোপ নেই।
তা হলে যাবে কেন? তোমার মত এত বড় অভিনেতা। তুমি যদি টিভিতে যাও সুপার স্টার হয়ে যাবে।
আসিফ হাসল। লীনা বলল, আমি মোটেও হাসির কথা বলিনি। তুমি হচ্ছে সুপার সুপার স্টার। তুমি নিজেও সেটা খুব ভালো করেই জান। জান না?
আসিফ জবাব দিল না। নিজের সম্পর্কে তার ধারণা বেশ উঁচু। সে খুব ভাল করেই জানে তার ক্ষমতা কতটুকু। তার আশপাশে যারা আছে তারাও জানে। ক্ষমতা যেমন কাজে আসছে না। তাদের দলটা ছোট. অভিনেতা-অভিনেত্রী তেমন নেই। মঞ্চে যেদিন শো হয়, সেদিন অডিটোরিয়াম প্রায় ফাঁকা থাকে। বড় কোনো দলে যদি সুযোগ পাওয়া যেত। তবে দলটির প্রতি তার মমতা আছে। এরা তার জন্যে অনেক করেছে। প্রথম বারেই প্রধান চরিত্র তাকে দিয়েছে। অন্য কোনো দল তা করত না।
লীনা বলল, তুমি কোনো কিছু নিয়ে খুব চিন্তা করছি বলে মনে হচ্ছে।
না তা করছি না। কোক শেষ হয়েছে? চল রওনা দিই। বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে!
লীনা বলল, কিছুক্ষণ হাঁটি, তারপর রিক্সা নেব। হাঁটতে ভাল লাগছে।
বেশ তো চল হাঁটি।
লীনা ছোট ছোট পা ফেলে হাঁটছে। সে আসিফের হাত ধরে আছে। রিহার্সেলের সময় খুব ক্লান্তি লাগছিল। এখন বেশ ভালো লাগছে। আসিফ ঘড়ি দেখল–রাত দশটা। আশপাশে কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ছিনতাই পার্টির সামনে না পড়লেই হল।
লীনা বলল, তোমাকে কি একটা জরুরি কথা বলতে যাচ্ছিলাম, এখন আর কিছুতেই মনে পড়ছে না।
তাহলে বোধ হয় তেমন জরুরি নয়।
না, জরুরি। খুব জরুরি। আমার মাথায় কি যেন হয়েছে বুঝলে–কিছু মনে থাকে না। ব্ৰেইন টিউমার ফিউমার কিছু একটা হয়েছে।
আসিফ তার জবাব দিল না। সিগারেট ধরাল। হাত ইশারা করে খালি রিকশা ডাকল। ক্লান্ত গলায় বলল, আর হাঁটতে পারছি না, চল রিকশায় উঠি। তোমার জরুরি কথাটা মনে পড়েছে?
না। তুমি যখন আশপাশে থাকবে না। তখন হয়ত মনে পড়বে। আমি ঠিক করেছি মনে পড়লেই একটা কাগজে লিখে ফেলব। কাগজটা থাকবে আমার ব্যাগে।
বুদ্ধিটা খারাপ না।
রিকশা দ্রুত চলছে। হাওয়ায় লীনার শাড়ির আঁচল উড়ছে। লীনা শাড়ির আঁচল সামলাতে সামলাতে বলল, এক সময় আমরা একটা গাড়ি কিনব, বুঝলে। তারপর রোজ রাতে গাড়িতে ঘুরব। তুমি চালাবে। আমি তোমার পাশে থাকব।
আসিফ জবাব দিল না। লীনা যখন কথা বলে তখন সে বেশির ভাগ সময় চুপচাপ থাকে। বিয়ের প্রথম দিকে লীনার অসুবিধা হত। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। আসিফ কথা না বললেও তার অসুবিধা হয় না।
আজি রিহার্সেলে নতুন মেয়েটাকে দেখেছ? পুষ্প নাম।
হ্যাঁ দেখলাম। কথাও তো বললাম। অভিনয় না কি পারে না, বজলু ভাই বলছিলেন।
মেয়েটা অভিনয় দেখে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিল।
হুঁ।
এই দেখে তোমার কোনো স্মৃতি মনে পড়েনি?
কোন স্মৃতি?
একটু মনে করে দেখ।
আসিফ তেমন কিছু মনে করতে পারল না। লীনার খানিকটা মন খারাপ হল। সে চাপা গলায় বলল, তোমার সঙ্গে ঠিক এইভাবে আমার পরিচয় হয়েছিল। মনে আছে? ময়মনসিংহ টাউন ক্লাবে নাটক করছিলে। তুমি হলে মধু পাগলা। মনে আছে?
আছে।
তোমার ছেলে মরে গেছে, তার ডেডবডি নিয়ে তুমি যাচ্ছ। আপন মনে কথা বলছি। অভিনয় যে এত সুন্দর হতে পারে। ঐদিন প্রথম বুঝলাম কেঁদো-কেটে একটা কাণ্ড করেছি। শেষে বাবা আমাকে হলের বাইরে নিয়ে যান। তখনো আমি ফোপাচ্ছিলাম। তোমার কিছু মনে নেই, তাই না।
মনে থাকবে না কেন? মনে আছে। নাটকটা সুবিধার ছিল না। মেলোড্রামা। খুবই দুর্বল সংলাপ।
রিকশা গলির মোড়ে থামল। জায়গাটা হচ্ছে শান্তিবাগা। গলির ভেতর তিনতলা বাড়ির দোতলায় তারা থাকে। একটাই ফ্ল্যাট। দু’টি পরিবার শেয়ার করে। কমন রান্নাঘর। তবে তাতে তেমন অসুবিধা হয় না।
বাড়ির গেটের কাছে এসে আসিফ থমকে দাঁড়াল। বিব্রত গলায় বলল, আমি তোমার সঙ্গে আর যাচ্ছি না। সকালে ফিরব।
লীনা অবাক হয়ে বলল, তার মানে!
শেলীর এ্যাপিন্ডিসাইটিস অপারেশন হবে রাত এগারটায়। থাকা দরকার। দুলাভাই চিটাগাং গেছেন। বড়। আপা একা।
এতক্ষণ এটা আমাকে বলনি কেন?
এই তো বললাম।
চল, আমিও তোমার সঙ্গে যাই।
তোমার যাওয়ার দরকার নেই। তুমি বিশ্রাম নাও। তোমার শরীর খারাপ–রেস্ট দরকার।
আমার শরীর খারাপ তোমাকে বলল কে?
কয়েক রাত ধরেই তো ঘুমুতে পারছি না। যতবার উঠি, দেখি চুপচাপ বিছানায় বসে আছি।