এমন সময় বাতি নিভে গেল। লেখক কি প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়েই না তাকা চেছন টেবিল ল্যাম্পটার
দিকে। লেখকদের প্রতি সহানুভূতিতে পুষ্পের চোখে প্রায় পানি এসে যাচ্ছে। এমন সময় দেখা গেল লেখকের স্ত্রী জরী আসছে। তার হাতে মোমবাতি। বাতাসের ঝাপটা থেকে বাতি আড়াল করে আসছে। তার মুখে কেমন যেন দুষ্ট দুষ্ট হাসি। পুরুপ দেখছে। মুগ্ধ হয়ে দেখছে। লেখক কথা বললেন। কি চমৎকার ভরাট গলা। স্বপ্ন মাখা স্বর।
লেখক : জরী তুমি এখনো জেগে আছ?
জরী : ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ শুনি খাটের নিচে খুটি খুঁট শব্দ হচ্ছে। কে যেন আবার খুক খুক করে কাশল। পুরুষ মানুষের কাশি। ভয়ে আমি অস্থির। খাটের নিচে কে যেন বসে আছে।
লেখক : আবার আজেবাজে কথা শুরু করেছ?
জরী : মোটেই কোনো আজেবাজে কথা না। আমার মনে হচ্ছে আমাদের খাটের নিচে একটা ভূত থাকে। পুরুষ ভূত। ভূতটার গায়ে তামাকের গন্ধ।
লেখক : জরী, তুমি দয়া করে মোমবাতিটা এখানে রেখে ঘুমিয়ে পড়। প্লিজ, প্লিজ…এই দেখ হাতজোড় করছি।
জরী : ঝড় বৃষ্টির রাতে একা একা ঘুমুব? ভূতটা যদি আমাকে কিছু করে। ওর মতলবটা আমার কাছে বেশি ভাল মনে হচ্ছে না।
লেখক : তোমার সঙ্গে ঘুমুতে পারলে আমি খুবই খুশি হতাম। কিন্তু তুমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি না… লেখালেখির একটা মুডের ব্যাপার। মুড সব সময় আসে না।
জরী : এখন এসেছে?
লেখক : হ্যাঁ এসেছে। সারারাত আমি লিখব।
জরী : আর আমি সারারাত ঐ ভূতটার সঙ্গে ঘুমুব?
লেখক : আমি একটা ক্লাইমেক্সে এসে থেমে আছি। আমার নায়ক অভাবে অনটনে পর্যুদস্ত। বেকার, হাতে একটা পয়সা নেই। সকালবেলা খবর পেয়েছে তার প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। সে ঠিক করেছে আত্মহত্যা করবে…।
জরী : এখনো করেনি?
লেখক : না করেনি। তবে স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন পথে পথে ঘুরছে।
জরী : সিদ্ধান্ত যখন নিয়েই ফেলেছে তাহলে আর দেরি করছ, কেন? কোনো একটা ট্রাকের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ুক। ঝামেলা চুকে যাক। আমরা আরাম করে ঘুমুতে যাই।
লেখক : বড্ড যন্ত্রণা করছি জরী।
জরী : আমি আর কত যন্ত্রণা করছি? তোমার নায়ক অনেক বেশি যন্ত্রণা করছে। স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েও পথে পথে ঘুরছে। এত ঘোরার দরকার কিরে ব্যাটা? লাফ দিয়ে কোনো একটা ট্রাকের নিচে পড়ে যা। ঢাকা শহরে কি ট্রাকের অভাব?
লেখক : (কড়া স্বরে) জরী।
জরী : আচ্ছা ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি। যদি চাও তো এক কাপ চা বানিয়ে দিতে পারি।
লেখক : এই মুহূর্তে আমি একটা জিনিস চাই, তা হচ্ছে নীরবে কাজ করার স্বাধীনতা।
জরী : বেশ স্বাধীনতা দিচ্ছি। স্বাধীনতার সঙ্গে এক কাপ চাও দিয়ে যাচ্ছি।
পুষ্প দেখল জরী দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে স্বামীর কাছ থেকে চলে আসছে। ঢুকেছে রান্নাঘরে। চা বানাচ্ছে। চা বানাতে বানাতে তার চোখে পানি এসে গেল। সে চোখে আঁচল দিয়ে খানিক্ষণ কাঁদল তারপর চায়ের কাপ হাতে বসার ঘরে ঢুকাল।
বজলু সাহেব চেঁচিয়ে বললেন, স্টপ। অভিনয় থেমে গেল। বজলু সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, পুরো ব্যাপারটা স্নো হয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই নাটক স্লো। এরকম একটা স্নো নাটকে তার চেয়েও স্লো এ্যাকশন পারলিক মোটেও একসেপ্টট করবে না। চা বানানোর জন্য পাশের ঘরে যাওয়া মানেই নাটক স্নো করে দেয়া। জরী, তোমাকে লেখকের পাশেই থাকতে হবে। ঐ ঘরেই ফ্লাস্কে চা বানানো আছে। তুমি শুধু ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে দেবে।
লীনা বলল, বজলু ভাই একটা সমস্যা আছে তো। ইমোশন বিন্ড আপ করার জন্যে আমার কিছু সময় দরকার। এই সময় তো আমি পাচ্ছি না।
যা করার সময়ের মধ্যেই করতে হবে।
এত অল্প সময়ে চোখে পানি আনতে পারব বলে তো মনে হচ্ছে না।
পারবে। অবশ্যই পারবে। না পারলেও ক্ষতি নেই। সাজেসানের ওপর দিয়ে কেটে বের হয়ে যাবে। নাও শুরু করা। স্টার্ট। লেখকের পাশে তুমি দাঁড়িয়ে আছ। শান্ত ভঙ্গিতে বলছি বেশ স্বাধীনতা দিচ্ছি। স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে এক কাপ চা দিয়ে যাচ্ছি। ওকে স্টার্ট। জরী, ডেলিভারি এত সফট দিও না। একটু হার্ড দিও।
অভিনয় শুরু হল। লেখক একমনে লিখছেন। জরী ফ্লাস্ক থেকে চা ঢালতে ঢালতে লেখকের দিকে আড়াচোখে তাকাচ্ছে। তার মন বিষাদে ভারাক্রান্ত। এক সময় টপ টপ করে চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। পুষ্প অবাক হয়ে দেখল কত সহজে মেয়েটির চোখে পানি এসে গেছে। এটা যেন অভিনয় নয়। বাস্তব জীবন। স্বামীসঙ্গ কাতর একটি মেয়ের অভিমানের অশ্রু। লেখক চোখ তুলে তাকালেন এবং অবাক হয়ে বললেন–
লেখক : কি হয়েছে, চোখে পানি কেন?
জরী : (চোখ মুছতে মুছতে) আমার খুব বাজে একটা চোখের অসুখ হয়েছে। রাত হলে চোখ কড় কড়া করে, চোখ দিয়ে পানি পড়ে।
লেখক : পল্টকে একবার দেখাও না কেন?
এই বলেই লেখক আবার লিখতে শুরু করেছেন।
জরী চলে আসছে। দরজার পাশে এসে থমকে দাঁড়াল। জরী তাকিয়ে আছে লেখকের দিকে। লেখক একমনে লিখছেন। জরীর চোখ দিয়ে জল পড়ছে।
পুষ্প বুঝতে ও পারেনি যে তার চোখ দিয়েও পানি পড়তে শুরু করেছে। মেয়েটির কষ্টে তার বুক ভেঙে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সে এক্ষুণি চেঁচিয়ে লেখককে বলবে-পাষণ্ড কোথাকার। সে কিছুই বলতে পারল না। দুহাতে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে উঠল। সবাই অবাক হয়ে তাকাল তার দিকে। তার খুবই খারাপ লাগছে, কিন্তু সে চোখের পানি থামাতে পারছে না। আসিফ এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে।