পুষ্পের ইচ্ছা করছে বাসায় ফিরে যেতে। রাত এখনো তেমন হয়নি। সে একটা রিকশা নিয়ে চলে যেতে পারবে। তার এত ভয়-টয় নেই। তবে ইচ্ছা করলেই তো আর যাওয়া যায় না। মীনা আপা তাকে নিয়ে এসেছেন। ফিরতে হবে মীনা আপার সঙ্গেই। মীনা আপার কাণ্ড কারখানাও অদ্ভুত। তাকে নিয়ে আসার পর আর কোনো খোঁজখবর নেই। ফার্স মতো একটা লোকের পাশে বসে ক্রমাগত কথা বলছে। ফার্স লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছে না। সে এইসব কথা মন দিয়ে শুনছে। বরং মনে হচ্ছে ফার্স লোকটা বিরক্ত হচ্ছে।
মীনা আপা পুষ্পদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন। কৃষি ব্যাংকে কাজ করেন আর নাটক থিয়েটার করেন। বয়স ত্ৰিশ ছাড়িয়ে গেছে। এখনো বিয়ে হয়নি। পুষ্পের ধারণা বিয়ে হবার সম্ভাবনা খুব কম। মীনা আপা বছর তিন আগে থেকে মোটা হতে শুরু করেছেন। এখন প্ৰায় মৈনাক পৰ্বত। থুতনিতে ভাঁজ পড়েছে। হাঁটার সময় থপ থপ শব্দ হয়।
মীনা আপার ধারণা টনসিল অপারেশনের জন্যে তার এটা হয়েছে। টনসিল অপারেশন না হলে আগের মতো হালকা পাতলা থাকতেন। এই নাটকে মীনা আপা কিসের পার্ট করেন কে
জানে? আসিফ এসে ঢুকল ঠিক সাড়ে আটটায়। দরজা থেকেই লীনার দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসি হাসল। এই হাসির অনেকগুলি অৰ্থ। আট বছর পাশাপাশি থাকায় লীনা এখন সব কটি অর্থ ধরতে পারে। অর্থগুলি হচ্ছে… দেরির জন্যে আমি লজ্জিত, সারাদিনের পরিশ্রমে আমি খানিকটা ক্লান্ত এবং একটা খারাপ খবর আছে।
আসিফকে ঠিক সুপুরুষ বলা যাবে না। শক্ত সমর্থ গড়ন। মাথা ভর্তি অগোছালো কোঁকড়ানো চুল। চোখ দু’টি ছোট, ঠোঁট বেশ পুরু। চওড়া কাঁধ। সব কিছু মিলিয়েও আলাদা কিছু আকর্ষণ তার মধ্যে আছে।
লীনা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। আট বছর এর সঙ্গে বিবাহিত জীবন কাটানোর পরেও এই মানুষটাকে দেখলে তার মধ্যে তরল অনুভূতি হয়। পাশে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে।
আসিফকে ঢুকতে দেখেই বজলু সাহেব চায়ের কাপ নামিয়ে হুংকার দিলেন, স্টার্ট কর। দ্বিতীয় দৃশ্য থেকে শুরু হবে। আজ কোনো প্রম্পটিং হবে না। একবার ডায়ালগ ভুলে গেলে পাঁচ টাকা করে জরিমানা। আসিফ যাও স্টেজে উঠে পড়। তোমরা চেয়ার আর টেবিল দাও, বা দিকে একটু পেছনে। দর্শকরা যেন শুধু সাইড ভিউ পায়। আমি বলল, পেছনের চৌকির পশ্চিম দিকের কোণায় একটা ভাঙা আছে। খেয়াল রাখবেন
আসিফ বলল, এক কাপ চ খেয়ে নিই বজলু ভাই। খুব টায়ার্ড ফিল করছি।
এক চুমুকে চা শেষ কর। কুইক। সাতদিন পর শো, অথচ এখনো একটা দিন ফুল রিহার্সেল দিতে পারলাম না।
লীনা ভেবেছিল আসিফ চায়ের পেয়ালা হাতে তার পাশে এসে দাঁড়াবে। টুকটাক কিছু কথাবার্তা বলবে। তা সে করল না। চায়ের কাপ হাতে প্রণবকে নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। আসিফ নিজের বাসার বাইরে এলে স্ত্রীর সঙ্গে কেমন যেন আলগা একটা ব্যবহার করে। যেন সে লজ্জা পায়।
পুষ্প বলল, চায়ের কাপ হাতে বারান্দার দিকে যে গেলেন, উনি কি এই নাটকের নায়ক?
লীনা হেসে বলল, তার চেহারাটা কি তোমার কাছে নায়কের মত মনে হল?
না, তা না।
হ্যাঁ, এ-ই নায়ক। নাটকের শুরুটা বলি, তোমার ভাল লাগবে। এক জন বিখ্যাত লেখকের উপন্যাস থেকে নাটক করা। গল্পটা খুব চমৎকার। শুনতে চাও?
হ্যাঁ চাই।
এই নাটকের নায়ক হচ্ছেন একজন লেখক। নতুন বিয়ে করেছেন। স্ত্রীর দিকে তার যতটা সময় দেয়া দরকার ততটা দিতে পারছেন না। রাত দশটার পর উনি লেখার খাতা নিয়ে বসেন। স্ত্রী বেচারী একা একা শুয়ে থাকে। মেয়েটির বয়স খুব কম, এই ধর আঠারো-উনিশ। তার খুব ইচ্ছে করে স্বামীর সঙ্গে রাত জেগে গল্প করতে। স্বামী বেচারা তা বুঝতে পারে না। সে তার উপন্যাস নিয়ে ব্যস্ত। ঘটনাটা শুরু হয়েছে এক রাতে। স্বামী লিখছে। হঠাৎ ঝড়বৃষ্টি শুরু হল। ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। লেখকের স্ত্রী একটা জুলন্ত মোমবাতি হাতে বসার ঘরে ঢুকাল।
লেখকের নাম কী?
পুরো নাটকে লেখকের কোনো নাম নেই। তাকে সব সময় লেখক বলা হয়েছে, তবে লেখকের স্ত্রীর নাম হচ্ছে জরী।
আপনি হচ্ছেন্ন লেখকের স্ত্রী, তাই না?
হ্যাঁ। কি করে বুঝলে?
আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল।
নাটক শুরু হল। স্টেজের এক প্রান্তে লেখার টেবিল। চেয়ারে পা তুলে আসিফ বসে আছে। বজলু সাহেব বললেন, চেয়ারে পা তুলে বসেছে কেন? এটা কি রকম বসা?
আসিফ বলল, ঘরোয়াভাবে বসেছি বজলু ভাই। খুব রিল্যাক্সড হয়ে বসা। পা নামিয়ে ঠিকঠাক মত বসলে ফর্মাল একটা ভাগ চলে আসে।
দেখতে ভাল লাগছে না। দেখতে ভাল লাগার একটা ব্যাপার আছে। দর্শক হিসাবে জিনিসটা দেখতে ভাল লাগতে হবে। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি…
বজলু সাহেব কথা শেষ করলেন না। আসিফ বলল, বজলু ভাই আমি চাচ্ছি যেন আমাকে। ভালো না লাগে। লেখকের সব কাণ্ডকারখানায় তার স্ত্রী যেমন বিরক্ত…আমি চাই দর্শকরাও যেন ঠিক তেমনিভাবে বিরক্ত হয়।
বজলু সাহেব শীতল গলায় বললেন, তুমি পা নামিয়ে বস। আসিফ পা নামাল।
বা হাতে মাথা হেলান দিয়ে লিখতে শুরু কর।
পুষ্প মুগ্ধ হয়ে দেখছে। মুগ্ধ হয়ে দেখার মতই ব্যাপার। একজন লেখক গভীর আগ্রহ নিয়ে লিখছেন এটা এত সুন্দর বোঝা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে লেখা থেমে যাচ্ছে, আবার শুরু হচ্ছে। লেখক একটা সিগারেট মুখে দিলেন। দেশলাই দিয়ে সিগারেটে আগুন ধরাতে গিয়ে ধরালেন না। নতুন কিছু মাথায় এসেছে। দেশলাই ফেলে কলম তুলে নিয়ে আবার ঝড়ের বেগে লিখতে শুরু করেছেন