আসিফ বলল, একটা গান কর না লীনা। লীনা শব্দ করে হাসল। হাসতে হাসতে বলল, আমার গান হয় নাকি?
এক সময় তো গুনগুন করতে। এখনো না হয় করে।
মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানো?
কি মনে হয়?
মনে হয় অভিনয় না করে গান করলে পারতাম। গানের দিকে আমার ঝোঁক ছিল। তোমার জন্যে অভিনয়ে চলে এলাম।
তোমার কি মনে হয় ভুল করেছ?
লীনা তার জবাব না দিয়ে বলল, সত্যি গান শুনতে চাও, গাইব?
গাও।
মাত্র চার লাইন কিন্তু।
গান চার লাইনেই ভাল।
লীন মৃদুস্বরে গাইল চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে। চার লাইন পর্যন্ত যেতেই পারল না। কেঁদো-কেটে অস্থির হল। আসিফ বলল, কাদছ কেন?
জানি না কেন? আমার প্রায়ই কাঁদতে ইচ্ছে করে। তোমার করে না?
আসিফ জবাব দেবার আগেই লীনা হঠাৎ করে বলল, আমি না যাওয়ায় তুমি খুশি হয়েছ তো?
একবার তো বললাম, খুশি হয়েছি।
আরেকবার বল।
খুশি হয়েছি। খুব খুশি হয়েছি।
না যাবার আরেকটা কারণও আছে। এটা তোমাকে বলিনি, কারণ তোমার মনটা খারাপ হবে।
মন খারাপ হবে না। তুমি বল।
এ মাসের সতের তারিখে আমাদের বড় মেয়ের মৃত্যুদিন। এই দিনে আমরা দু’জন দুজায়গায় থাকব তা কি করে হয়!
না, তা হয় না।
এ দিন আমার দু’জন হাত ধরাধরি করে সারাক্ষণ পাশাপাশি বসে থাকব।
লীনা চোখের পানি মুছে ক্ষীণ স্বরে বলল, আমার মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানো? আমরা যদি আমাদের জীবনের সবচে প্ৰিয় জিনিস ছেড়ে দিই, তাহলে হয়ত আমাদের এবারের বাচ্চাটা বেঁচে যাবে। এক ধরনের সেক্রিাফাইস। আমার এই কথায় তুমি কি কিছু মনে করলে?
দীর্ঘ সময় চুপচাপ থেকে আসিফ বলল, না, কিছু মনে করিনি।
এটা একটা কথার কথা।
কথার কথা কেন হবে? তোমার মনের মধ্যে এটা আছে। অাছে না?। লীনা চুপ করে রইল।
আসিফ বলল, বড় তৃষ্ণা পেয়েছে। এক গ্লাস পানি খাওয়াবে?
লীনা বিছানা থেকে নেমে বাতি জ্বালাল। আর তখনি ওয়ারড্রোবের মাথায় রাখা ছবির ফ্রেম দু’টির দিকে আসিফের চোখ পড়ল। লোপা এবং ত্রিপার বাঁধান ছবি। ট্রাঙ্কে তালাবদ্ধ থাকে। কখনো বের করা হয় না। আজ বের করা হয়েছে।
লীনা ছবি দু’টির দিকে তাকিয়ে বলল, সতের তারিখের পর আবার লুকিয়ে ফেলব।
আসিফ বলল, লুকিয়ে ফেলার দরকার কি, থাকুক। তুমি যাও, পানি নিয়ে এস।
আসিফ তাকিয়ে রইল। ছবি দু’টির দিকে। আহ, কি সুন্দর দুই মা-মণি! একজন আবার রাগ করে ঠোঁট উল্টে আছে। অন্যজন কেমন চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছে। যেন পৃথিবীর রহস্য দেখে তার বিস্ময়ের সীমা নেই।
আসিফের বুক জ্বালা করতে লাগল। ছবি দু’টির দিকে তাকালেই তার অসহ্য কষ্ট হয়। সে ক্ষীণ স্বরে বলল, ত্রপা, ত্ৰিপা মামণি। কেমন আছ গো?
ত্রপা জবাব দিল না, জবাব দিল লীনা। সে স্নিগ্ধ গলায় বলল, পানি নাও।
আসিফ এক চুমুকে পানি শেষ করে সহজ গলায় বলল, আমি আর অভিনয় করব না। লীনা তোমাকে কথা দিচ্ছি। বাতি নিভিয়ে দাও, চোখে আলো লাগছে।
তুমি কি আমার ওপর রাগ করলে?
না লীনা। রাগ করিনি।
আমি একটা কথার কথা বললাম।
বাতি নিভিয়ে দাও লীনা। বাতি নিভিয়ে দাও।
নীলা বাতি নিভিয়ে দিল।
আসিফদের শো হল না
আসিফদের শো হল না। শো-এর দিন আসিফ এবং লীনা ছাড়া দলের সবাই একত্রিত হল। মজনু বারান্দায় চায়ের কেতলি বসিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। বজলুসাহেব তিক্ত গলায় বললেন, কেউ গিয়ে চড় দিয়ে গাধাটাকে থামাও তো, অসহ্য! বলতে বলতে তিনি নিজেও কেঁদে ফেললেন। এবং কাঁদলেন শিশুদের মত শব্দ করে। তাঁকে ঘিরে মূর্তির মতো সবাই বসে রইল। কেউ একটি শব্দও করল না। শুধু পুষ্পকে দেখে মনে হল, যে কোনো মুহূর্তে এই মেয়েটি ভেঙে পড়বে। তবে সে ভেঙে পড়ল না। সাজঘরের এক কোণায় চুপচাপ বসে রইল। বজলু সাহেব যখন বললেন, খামোখা বসে আছে কেন সবাই? যাও, বাসায় চলে যাও। তখনি শুধু তার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। কেউ এসে সান্তুনার হাত তার মাথায় রাখল না।
কিছুদিন পরই থিয়েটারের এই দলটি নতুন নাটকের মহড়া শুরু করল। নাটকের নাম–হলুদ নদী, সবুজ বন। মজনু আবার তার জাম্বোসাইজের কেতলিতে চায়ের পানি বসিয়ে দিল। জলিল সাহেব জমিয়ে আদিরসের গল্প শুরু করলেন। বজলু সাহেব উত্তেজিত ভঙ্গিতে ছোটাছুটি করতে লাগলেন। সবই আগের মত, শুধু আসিফ এবং লীনা নেই। এরা দু’জন যেন হঠাৎ উবে গেছে। অথচ সবাই জানে তারা আগের জায়গাতেই আছে, সেই আগের বাসায়। পূর্ব নাট্যদলের যেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি, তেমনি আসিফ এবং লীনারাও কোনো পরিবর্তন হয়নি। আসিফ শুধু বলেছে, সে অভিনয় করবে না। কেন অভিনয় করবে না, সমস্যাটা কি এই কথা পূর্ব নাট্যদলের কেউ চূড়ান্ত পারেনি। অনেক চেষ্টা করেও পারেনি। শুধু পুষ্প খানিকটা জানে। তাকে আসিফ একটা চিঠি লিখেছিল।
পুষ্প,
আমার খুব ইচ্ছা ছিল মুখোমুখি কিছুক্ষণ তোমার সঙ্গে কথা বলি, কেন অভিনয় ছেড়ে দিলাম। তা তোমাকে গুছিয়ে বলি। তা সম্ভব হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না, জানতে চেও না।
দেখ পুষ্প, অভিনয় আমায় বড়ই সখের জিনিস। এর কারণে আমি যেমন একদিকে সব কিছু হারিয়েছি, আবার তেমনি অনেক পেয়েছিও। লীনার মতো একটি মেয়েকে পাশে পাওয়া কত বড় ভাগ্যের ব্যাপার, তা আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না। আর শুধু কি লীনা? তোমাকেও কি আমি অভিনয়ের কারণেই পাইনি? লজ্জা পেও না পুষ্প, সত্যি কথাটা বলে ফেললাম। বেশির ভাগ সময়ই আমরা সত্যি কথা লুকিয়ে রাখি, তবু মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে করে।
যে কথা বলছিলাম, অভিনয় আমার জীবনের অনেকখানি, কে জানে হয়তবা সবখানি। সেই অভিনয় থেকে সরে আসা যে কি কষ্টের, তা মনে হয় তুমি বুঝতে পারছি। কেন সরে এলাম? পুরোটা তোমাকে বলতে পারছি না। শুধু এইটুকু জেনে রাখ, আমার এবং লীনার জীবনে একটি গভীর ট্র্যাজিডি আছে। গহীন একটি ক্ষত। লীনার কেন জানি মনে হয়েছে, আমরা দু’জনই যদি বড় কোনো সেক্ৰিফাইস করি, তাহলে হয়তবা ট্র্যাজিডির অবসান হবে। লীনার মনের শান্তির জন্যে এইটুকু আমাকে করতেই হবে। অভিনয় তো জীবনের চেয়ে বড় নয়, তাই না?
তোমাকে এই চিঠি লেখার উদ্দেশ্য কিন্তু দুঃখের কাঁদুনি গাওয়া নয়। এই জিনিস। আমি কখনো করি না। তোমাকে চিঠি লেখার একটিই কারণ, তা হচ্ছে তুমি যেন অভিনয় ছেড়ে না দাও। অভিনয়ের যে অসম্ভব ক্ষমতা নিয়ে তুমি জন্মেছ, সেই ক্ষমতাকে নষ্ট করো না। সব মানুষকে সব ক্ষমতা দিয়ে পাঠানো হয় না। যাদেরকে দেয়া হয়, তাদের ওপর আপনাতেই সেই বিশেষ প্রতিভার লালন করার দায়িত্ব এসে পড়ে। তুমি অনেক বড় হবে পুষ্প। অনেক অনেক বড়। এইটি আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।
সত্যি সত্যি যদি তাই হয়, তাহলে সেদিন আমার চেয়ে সুখী কেউ হবে না, এই কথাটি তোমাকে জানানোর জন্যেই আমার দীর্ঘ চিঠি। ভাল থেক, সুখে থেক।
পনের বছর পরের কথা
পনের বছর পরের কথা।