লীনা চা এনে দিল। আসিফ চায়ে চুমুক দিয়ে একটা তৃপ্তির ভঙ্গি করল। লীনা বলল, হাশমত সাহেবের চোঁচামেচি শুনতে কেমন লাগছে?
ইন্টারেস্টিং! একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম।–ঝগড়ার সময় বা প্রচণ্ড রাগের সময় মানুষের গলায় কোনো রকম ভেরিয়েশন থাকে না। এক স্কেলে সে কথা বলে, এবং বলে অতি দ্রুত। আমার ধারণা, তার কথা বলার স্পিড তখন তিনগুণ বেড়ে যায়।
লীনা ক্লান্ত গলায় বলল, তুমি দয়া করে হাশমত সাহেবকে বল তো চুপ করার জন্যে। এই ভোরবেলায় উনি কি শুরু করেছেন? খুব খারাপ লাগছে।
আসিফ সঙ্গে সঙ্গে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে উঠে চলে গেল। ভারী এবং গম্ভীর গলায় ডাকল, হাশমত সাহেব, এই যে হাশমত সাহেব।
জি।
একটু বাইরে আসুন তো ভাই।
কেন?
আসুন। আমার সঙ্গে একটা সিগারেট খান।
হাশমত সাহেব বিরক্ত মুখে বের হয়ে এলেন, ঝাঁঝাল গলায় বললেন, অসহ্য, বুঝলেন ভাই। অসহ্য, কানের কাছে রাতদিন ঘ্যানঘ্যান, ঘ্যানঘ্যান। লাইফ হেল করে দিয়েছে।
তাই বুঝি?
আর বলেন কেন ভাই। আমার মাথায় রক্ত উঠে গেছে।
মাঝে মাঝে মাথায় রক্ত ওঠা ভাল। এত ব্রেইন পরিষ্কার থাকে। বলতে বলতে আসিফ হাশমিত সাহেবের কাধে হাত রেখে হাসল। লীনা দূর থেকে লক্ষ্য করল, এই হাসি শুধু হাসি নয়, এর মধ্যে অনেকখানি অভিনয় মিশে আছে। এই হাসি দিয়েই আসিফ অনেক কিছু বলতে চাচ্ছে। বুঝিয়ে দিচ্ছে সংসারে অবুঝ মেয়েরা থাকে। তারা অনেক অন্যায় করে। এইসব অন্যায় দেখতে হয় ক্ষমা ও প্রশ্রয়ের চোখে। সব কিছু ধরতে নেই।
নিন হাশমত সাহেব। একটি সিগারেট ধরান, তারপর এই চমৎকার সকালটা একটু দেখুন। আর ভাই সকাল। রাতে ঘুমাতে দেয় নাই। খালি ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ।
আসিফ আবার হাসল। নিজেই সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে বলল, আরেক কাপ চা খেতে ইচ্ছে করছে। ভাবীকে ডেকে বলুন তো, আমাদের দু’জনকে দুকাপ চা দিতে। এরকম ভোরবেলায় রাগারগি করা ঠিক হচ্ছে না। রাগারগিটা রাতের জন্য মুলতবি থাক। রাতে আবার নতুন উদ্যমে শুরু করবেন।
হাশমত আলি সত্যি সত্যি খুবই সহজ এবং স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, ও বেনু, দেখি আমাদের চা দাও তো। নোনতা বিসকিট কিছু আছে কিনা দেখ। আমার আবার খালি পেটে চা সহ্য হয় না।
বেনু চোখ মুছে চা বানাতে গেল।
আসিফ বলল, বুঝলেন হাশমত সাহেব, অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছি ভোর নিয়ে একটা কবিতা মনে করতে। মনে করতে পারছি না। বাঙালি কবিরা ভোর নিয়ে বেশি কবিতা লেখেননি বলে মনে হচ্ছে।
লিখবে কোথেকে বলেন? কয়টা কবি ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠে? এরা রাত দুটো-তিনটে পর্যন্ত জাগে, ওঠে সকাল দশটার পর।
আসিফ শব্দ করে হেসে উঠল।
হাসি ভয়াবহ সংক্রামক ব্যাধির চেয়েও সংক্রামক। হাশমত আলিও হাসতে শুরু করলেন। হাসতে হাসতে বললেন, ভোরের একটা কবিতা মনে পড়ছে রে ভাই–ভোর হল দোর খোল… হা হা হা।
বেনু চা নিয়ে এসেছে। হাশমত বলল, বেনু আসিফ ভাইকে বলেছ যে ক’দিন ভাবী থাকবে না। দুবেলা আমাদের সঙ্গে খাবে। না খেলে আমরা খুবই মাইন্ড করব। ভাল করে বলে त९3।
ভাইজান কি আমার কথা শুনব?
অফকোর্স শুনবে। আমরা থাকতে বাইরে খাবে, এটা কি কথা। ভাইসাবের উপলক্ষে ভালমন্দ কিছু খাব। বেনু, জিরা বাটা দিয়ে তুমি যে গোশত রাঁধ, এইটা রাঁধবে মনে করে।
আসিফের বড় ভাল লাগছে। কিছুক্ষণ আগে কি কুৎসিত চেঁচামেচি হচ্ছিল। এখন কি চমৎকার করেই না দু’জন কথা বলছে। এরা দু’জন ভোরের আনন্দ অনেক গুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।
লীনা কাপড় গোছাচ্ছে। ঠিক হয়েছে, আসিফ ব্রিটিশ কাউন্সিলে যাবার পথে লীনার মার বাড়িতে তাকে রেখে আসবে।
লীনা বলল, তুমি আবার এয়ারপোর্টে উপস্থিত হয়ে না।
কেন?
তুমি একা থাকবে, আমি চলে যাব–ভাবতেই খারাপ লাগছে। শেষে কেঁদে-টেনে ফেলব। দুলাভাই এটা নিয়ে সারাজীবন ঠাট্টা করবেন। কেউ তোমাকে নিয়ে ঠাট্টা করলে আমার ভাল লাগে না।
আসিফ বলল, তোমার প্লেন তো সেই রাতে। সারাদিন তোমার মার বাসায় কি করবে? তার চেয়ে চল, ঐ ব্রিটিশ মহিলা কি বলেন শুনি। অনেক শেখার ব্যাপার থাকতে পারে।
শেখার ব্যাপার থাকলে তুমি শেখ। আমার আর কিছু শিখতে ইচ্ছা করছে না।
আসিফ ইতস্তত করে বলল, তোমার সঙ্গে টাকা-পয়সা বিশেষ কিছু দিতে পারলাম না। কিছু মনে কর না লীনা। যা দরকার লাগে, তুমি তোমার দুলাভাইয়ের কাছ থেকে নিও, আমি পরে ব্যবস্থা করব।
লীনা বলল, সঙ্গে যা আছে, যথেষ্টই আছে। ঐ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তোমার জন্যে কি আনব বল।
একটা কাজ করা পাঞ্জাবি আর জয়পুরী স্যান্ডেল।
আর কিছু?
আর কিছু না।
নাটকের ওপর বইপত্র যদি কিছু পাই, আনব না?
অবশ্যই আনবে।
লীনা অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসতে লাগল। আসিফ বলল, হাসছ কেন?
এমনি হাসছি। এটা যদি অভিনয়ের দৃশ্য হত, তাহলে বোধহয় হাসাটা ঠিক হত না। তাই না?
কি বলছ তুমি বুঝতে পারছি না।
আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। আজ ভোর থেকে মাথার মধ্যে শুধু আবোল-তবোেল চিন্তা ঢুকছে। দেশের বাইরে যাচ্ছি, সে জন্যেই বোধ হয়। দেশের বাইরে তো কখনো যাইনি।
তোমার শরীর ঠিক আছে তো?
শরীর ঠিক আছে?
তুমি কেন জানি আজ অতিরিক্ত রকমের গম্ভীর হয়ে আছে। কী ব্যাপার লীনা?
লীনা বলল, একটু অপেক্ষা কর। ব্যাগটা গুছিয়ে নিই, তারপর হাসি মুখে তোমার সঙ্গে গল্প করব। তুমি চাইলে জানালা বন্ধ করে, দরজার পর্দা ফেলে ঘর একটু আঁধার করে নেব। তারপর দুজনে মুখোমুখি, গভীর দুঃখে দুঃখি, আঁধারে ঢাকিয়া গেছে আর সব।