পুষ্প চুপচাপ বসে আছে। বসে থাকতে থাকতে এক সময় সে ঘুমিয়েও পড়ল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চমৎকার একটা স্বপ্নও দেখল। এই স্বপ্নটি বড়ো মধুর ছিল, তবু সে ঘুমের মধ্যেই খুব কাঁদল।
খুব ভোরে লীনার ঘুম ভাঙল
খুব ভোরে লীনার ঘুম ভাঙল। এই ভোরগুলিকেই বোধ হয় কাকভোর বলে। তারস্বরে কাক ডাকছে। ঘরের ভেতর আঁধার ও আলো। সেই আলো-অন্ধকারে মিশে পৃথিবীটাকে অন্যরকম করে রেখেছে। শহরের ভোরে পাখির ডাক শোনা যায় না। কর্কশ। কাক ডাকে। কাককে তো আর কেউ পাখি ভাবে না।
আসিফ পাশ ফিরে ঘুমুচ্ছে। একটা হাত মুখের উপর ফেলে রাখার মুখ দেখা যাচ্ছে না। লীনার একবার ইচ্ছা করল, আসিফকে ডেকে তোলে। এত আরাম করে সে ঘুমুচ্ছে যে ডাকতে ইচ্ছা করল না। লীনা দরজা খুলে বাইরে এল। রান্নাঘরে খুটাখুটি শব্দ হচ্ছে। বেনু তার বাচ্চার জন্যে দুধ গরম করছে। লীনা রান্নাঘরের ঢুকাল। চায়ের পানি চড়াবে। অনেক’দিন বেড-টি খাওয়া হয় না।
বেনু মুখ তুলে লীনাকে দেখল। কিছু বলল না। বেনুর মুখ অস্বাভাবিক গষ্ঠীর। লীনা বলল, বাচ্চা জেগে গেছে?
জি।
চা খাবে বেনু? আমি চা করছি।
চা খাব না। আজ আপনি চলে যাবেন, তাই না?
হ্যাঁ।
মন খারাপ লাগে?
একটু লাগে। তোমারও কী মন খারাপ? কেমন যেন লাগছে। ঝগড়া-টগড়া হয়েছে?
বেনু খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার মনটা খুব খারাপ। খুঁকির বাবা কাল রাতে আমাকে চড় দিয়েছে। নিজের বাবা-মা কোনোদিন আমার গায়ে হাত তুলে নাই। আর ও কি না…।
বেনুর বাচ্চা কাঁদছে। সে দুধ নিয়ে চলে গেল। লীনাকে সুন্দর ভোরবেলায় অসুন্দর একটি ছবির মুখোমুখি হতে হল। বেচারা বেনু। আজ সারাদিন খুব মন খারাপ করে থাকবে।
আগামীকাল বা পরশুও এরকম যাবে। তারপর আস্তে আস্তে সব ভুলে যাবে। স্বামীর সঙ্গে হাসবে, গল্প করবে। স্বামীর প্রয়োজনে লাজুক ভঙ্গিতে ব্লাউজের হুঁক খুলবে। তারপর আবার এক’দিন এ রকম একটা কাণ্ড ঘটবে। স্বামী চড় বসাবে কিংবা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে মেঝেতে।
লীনা দুকাপ চা বানিয়ে শোবার ঘরে ঢুকল। আসিফ একটা চাদর টেনে গলা পর্যন্ত ঢেকে নিয়েছে। বেচারার বোধ হয় শীত করছিল। ডেকে তুলে চা খেতে বলবে? না থাক, বেচারা ঘুমুক। যদিও ডেকে তুললেই ভাল হত। আজ লীনা চলে যাবে। যাবার দিনটায় যত বেশি পারা যায় গল্প করা উচিত।
লীনা আসিফের পাশে বসে চা খাচ্ছে। চা খেতে খেতে হঠাৎ তার মনে হল— তাদের দুজনের সম্পর্কে একটা অস্বাভাবিকতা আছে। আসিফ কখনো কোনো কারণেই তার সঙ্গে রাগ করেনি। চড়া গলায় কথা বলেনি। লীনা নিজে কোনো মহামানবী নয়। আসিফের রাগ করার মত এই দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে অনেক কিছুই সে করেছে। অথচ সে সব যেন আসিফকে স্পৰ্শই করেনি। এর কারণটা কী? এও কী এক ধরনের অভিনয় নয়?
একজন বড়ো মাপের অভিনেতা কি সব সময়ই অভিনয় করে না? একজন দক্ষ, শুধু দক্ষ নয়–অসাধারণ প্রতিভাবান অভিনেতা নিজেকে সব সময় দখলে রাখেন। সারাক্ষণ অভিনয় করে যান।
অভিনয় সব মানুষই করে। যে স্ত্রীকে অসহ্য বোধ হয়, তার সঙ্গেও সে হাসি মুখে কথা বলে। অভিনেতা সেই জিনিসটাকেই অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে যান।
লীনা অস্বস্তি বোধ করছে। আসিফ সম্পর্কে এ রকম ধারণা তার শুধু আজ না, অনেকবারই হয়েছে। বিয়ের দ্বিতীয় বছরে সন্দেহটা তার প্রথম হল। সে লক্ষ্য করল ভালবাসাবাসির সময় আসিফ একেক সময় একেক রকম আচরণ করে। যেন সে ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করছে। একজন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করতে পারে, কিন্তু তার মূল সুরটি কিছুতেই কাটবে না। মূল সুর অবশ্যই বজায় থাকবে। আসিফের বেলায় তা থাকে না। পুরো ব্যাপারটাই তার বেলায় বদলে যায়। অভিনয় ছাড়া এ জিনিস সম্ভব নয়।
লীনা চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে একটা হাত আসিফের গায়ে রাখল। মৃদু স্বরে ডাকল, এ্যাই।
আসিফ সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠল। লীনা বলল, হাত-মুখ ধুয়ে আস, চা গরম করে আনছি।
আরেকটু ঘুমুতে ইচ্ছা করছে যে।
তাহলে ঘুমাও।
লীনা আবার বারান্দায় চলে এল। যদিও সে জানে, আসিফ ঘুমুবে না, উঠে আসবে। সে ঠিক তাই করবে যা একজন আদর্শ স্বামীর করা উচিত। এর বাইরে সে একচুলও যাবে না।
আসিফ সত্যি সত্যি উঠে এল। বাথরুম থেকে হাত-মুখ ধুয়ে এসে পাশে দাঁড়াল। হাসিমুখে বলল, এ তো মনে হচ্ছে একেবারে প্রত্যুষ লগ্ন।
লীনা বলল, তুমি কি বেরুবে নাকি আজ?
হ্যাঁ।
কোথায় যাবে?
ব্রিটিশ কাউন্সিলে যাব। এগারটার সময় একটা ছোটখাটো ওয়ার্কশপের মত হবে। ব্রিটিশ একজন মহিলা নাটকের বিশেষজ্ঞ এসেছেন। নাটক নিয়ে কথা বলবেন, শুনে আসি। তুমি যাবে?
না।
তোমার প্লেন তো রাতে। চল না। যাই।
লীনা জবাব না দিয়ে চা আনতে গেল।
পাশের ঘরে উঁচু গলায় হাশমত আলি চিৎকার করছে, তুই পেয়েছিস কী? তুই ভাবস কী? তুই কী ইয়ার্কি করস? তুই আমারে চিনস না? .
গ্ৰাম্য ভাষা, কুৎসিত ভঙ্গির চেঁচামেচি। বেনুর গলা পাওয়া যাচ্ছে না। তবে সে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। লীনা লক্ষ্য করল, আসিফ খুব আগ্রহ নিয়ে ঝগড়ার কথাবার্তা শোনার চেষ্টা করছে। এই আগ্রহ অশোভন। অন্যদের কুৎসিত চেঁচামেচি সে এত আগ্রহ নিয়ে শুনবে কেন? লীনা রাগ করতে গিয়েও করতে পারল না। তার মনে হল–ঝগড়াটা আসিফের শোনা উচিত। একজন অভিনেতাকে চারপাশ থেকে শিখতে হবে। ক্যারেক্টর এ্যানালাইসিস করতে হবে। ঝগড়ার সময় কোন পর্দায় চেচাবে, কোন ভঙ্গিতে কথা বলবে, মুখের কোন মাংসপেশী ফুলে ফুলে উঠবে, ভ্রূ কোচকাবে কি কোচকাবে না, এসব লক্ষ্য না করতে পারলে বড় হবার পথ কোথায়?