পুষ্প বলল, নাটক আপনাদের খুব প্রিয়?
হ্যাঁ প্ৰিয়। খুবই প্রিয়। নাটকের একটা দল মানে পরিবারের বাইরে একটা পরিবার।
পুষ্প চুপ করে রইল।
লীনা বলল, কিছুদিন যাক, তখন তুমিও এটা বুঝবে। সবাই কিছুদিন পরপর একসঙ্গে হতে না পারলে দেখবে ভাল লাগছে না। অস্থির অস্থির লাগছে। গ্রুপ নাটকের কত সমস্যা, তার পরেও যে গ্রুপ নাটক টিকে আছে–কেন আছে? এই কারণেই আছে।
বিদায় নেবার সময় লীনা। আপা তার দিকে তাকিয়ে এমন মিষ্টি করে হাসল, তবু তার অসম্ভব মন খারাপ হল। কারণটা খুব অদ্ভুত।
বৃষ্টি পড়ছিল বাইরে। তারা সবাই বারান্দায়। জলিল ভাই বললেন, সবাইকে আমি গাড়িতে পৌঁছে দেব। দরকার হলে দুট্রিপ দেব। নো প্রবলেম। সবাই তাতে খুশি। আর আশ্চর্য, আসিফ ভাই বলল, আমাদের পৌঁছে দিতে হবে না। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে রিকশায় করে যাওয়ার অন্য রকম আনন্দ আছে। কাজেই শুভ রাত্রি।
তারা সত্যি সত্যি রাস্তায় নামল। আসিফ ভাই লীনা। আপার হাত ধরে হাঁটছেন। বৃষ্টির মধ্যে দু’জন নেমে যাচ্ছে।
গা ঘোষাঘেষি করে হাঁটছে। কি অপূর্ব দৃশ্য! প্রথম কয়েক মুহূর্ত পুষ্পের মন আনন্দে পূর্ণ হল। তার পরপরই চোখে পানি এসে পড়ার মত কষ্ট হতে লাগল।
কেন তার কষ্ট হচ্ছে এটা সে জানে। কিন্তু তার বিশ্বাস করতে মন চাচ্ছে না। তার কষ্টের কারণটা সে জানে, অথচ কাউকে সে বলতে পারবে না–এও একটা বিরাট কষ্ট। ভাল একজন বন্ধু যদি তার থাকত, তাহলে কি সে তাকে এটা বলতে পারত? না পারত না। কোনোদিন কাউকে এটা বলা যাবে না। চিরকাল গোপন রাখার মত কিছু কিছু ঘটনা সব মানুষের জীবনেই হয়ত ঘটে। বাইরের কেউ কোনোদিন তা জানতে পারে না। বড়চাচার মেয়ে মিতুরও একটা গোপন কথা আছে, যা সে কাউকে বলতে পারবে না। শুধু পুষ্পকে এক’দিন কাঁদতে কাঁদতে বলেছে, একটা গোপন কথা তোকে বলব। কাউকে না বলতে পারলে আমি মরে যাব।
পুষ্প বলল, কী?
মিতু বলল, কিছু না, এমনি ঠাট্টা করছি। বলতে বলতে আবার কেঁদে অস্থির হল। মিতুর গোপন কথা পুষ্প জানে না। মিতু বলেনি। কাউকে হয়ত সে আর বলবে না। গোপন কথা বলতে গোপনই থেকে যাবে।
পুষ্প বাড়িতে ঢুকে শান্ত ভঙ্গিতে হাত-মুখ ধুয়ে মাকে গিয়ে বলল, ভাত দাও মা।
মমতা বললেন, তোর কি হয়েছে রে? এমন লাগছে কেন?
ভীষণ মাথা ধরেছে। খেয়ে শুয়ে পড়ব।
তোর চাচির ওখানে গিয়ে খেয়ে আয়। ডাল ছাড়া ঘরে আর কিছু খাবার নেই।
ডাল দিয়েই খাব। ও ঘরে এখন আর যেতে ইচ্ছা করছে না।
মমতা উঠে গিয়ে রান্নাঘরেই মেয়েকে ভাত বেড়ে দিলেন। পুষ্প বলল, তুমি খাবে না মা?
মমতা বললেন, বুকে অম্বলের ব্যথা উঠেছে, এক কাপ দুধ খেয়ে শুয়ে পড়ব। তোকে একটা ডিম ভেজ দেই।
দাও।
মমতা ডিম ভাজতে ভাজতে বললেন, আজ এক কাণ্ড হয়েছে সন্ধ্যাবেলা একটা গাড়ি করে দুতিন জন মহিলা এসে উপস্থিত। কাউকে চিনি না বললাম–কাকে চান?
মোটামত একজন মহিলা বললেন, আমরা আপনার প্রতিবেশী, বেড়াতে এসেছি। আমার তখনি সন্দেহ হল। প্রতিবেশী হলে গাড়ি করে আসবে কেন? কেমন অস্বস্তি অস্বস্তি ভাব। হেন তেন নানান কথার পর ফাঁস করে বলল, আপনার বড় মেয়েটার কি বিয়ে দেবেন? চিন্তা কর অবস্থা। চিনি না জানি না এসেই বলে কি না–বড় মেয়ের রিয়ে দেবেন?
পুষ্প বলল, তুমি কি বললে?
আমি আবার কি বলব? আমি বললাম, জি না। মেয়ের বিয়ের কথা এখনো ভাবছি না। ওমা, তার পরেও যায় না। বসেই আছে।
পুষ্প বলল, চুপ কর তো মা। শুনতে ভাল লাগছে না।
আহা, আসল মজাটা তো শুনলি না। খুব ফর্সা করে একজন মহিলা আছেন, উনি বললেন বিয়ের সম্পর্ক এলে মুখের ওপর না বলতে নেই আপা। প্রপোজাল শুনুন, তারপর বলুন না।
আমি বললাম, এম এ পাস করার আগে মেয়ের বাবা মেয়ের বিয়ে দেবে না। ভদ্রমহিলা বললেন, এম এ পাস তো বিয়ের পরেও করতে পারে। কি যে যন্ত্রণা! কিছুতেই যাবে না।
তারপর বিদেয় করলে কি ভাবে?
শেষপর্যন্ত বললাম, আপা, আমাদের এক জায়গায় যাবার কথা আছে। তারপর উঠল।
পুষ্প বলল, তোমার মজার কথা শেষ হয়েছে, না আরো বাকি আছে?
আসলটাই তো বলা হয়নি। ওরা চলে গেলে দেখি টেবিলের উপর চশমা পরা একটা ছেলের ছবি। ইচ্ছা করে ফেলে গেছে। মিতুর কাছে ছবিটা আছে। দেখতে চাইলে ওকে বল।
আমি কেন দেখতে চাইব?
আহা রেগে যাচ্ছিস কেন? দেখতে না চাইলে দেখবি না। নাটক থিয়েটার করতে পারিস, একটা ছেলের ছবি দেখলে তোর মান যাবে নাকি?
নাটক থিয়েটার আমি আর করব না।
কি বললি?
নাটক আমি আর করব না।
হঠাৎ কি হল?
আমার ভাল লাগছে না।
পুষ্প উঠে চলে গেল। সে রাতে মিতুর সঙ্গে শোয়। আজ নিশ্চয়ই দেশের বাড়ি থেকে কেউ এসেছে। চিড়িয়াখানা দেখবে কিংবা চিকিৎসা করবে। কারণ মিতুর বিছানায় অপরিচিত একজন মহিলা ঘুমুচ্ছেন। মিতুও তার স্বভাবমত হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমুচ্ছে। পুষ্প তার নিজের শোবার জায়গা খোজার জন্যে ব্যস্ত হল না। ভেতরের দিকে বারান্দায় চলে গেল। রেলিং দেয়া বারান্দায় এক কোণে একটা ইজিচেয়ার। পুষ্পর বাবা এই চেয়ারে বসে রোজ সকালে খবরের কাগজ পড়েন। রাতে চেয়ারটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। আজ নেয়া হয়নি।
পুষ্প চেয়ারে এসে বসল। বৃষ্টি হচ্ছে না। ঝিঝি ডাকছে। ঝিঝি ডাকা মানে বাকি রাতটায় আর বৃষ্টি হবে না। আকাশ পরিষ্কার হয়ে চাঁদ উঠবে। চাঁদ উঠলে পুষ্পদের বাড়ির ভেতরটা খুব সুন্দর দেখা যায়। ভেতরের উঠোনে দুটো প্রকাণ্ড কামিনী গাছ আছে। সেই গাছে চাঁদের আলো পড়ে। বড়োই রহস্যময় লাগে।