তার স্ত্রী হাসিনা ক্ষীণ স্বরে বললেন, তেলাপিয়া মাছ।
তেলাপিয়া মাছ রাঁধতে তোমাকে কে বলল?
সবাই খায়।
সবাই খায়? কোন শালা তেলাপিয়া মাছ খায়? বল কোন শালা খায়?
তিনি মাছের বাটি উল্টে ফেলে গটি গট করে উঠে পাশে ছোট ভাইদের বাসায় খেতে গেলেন। সেখানেও তেলাপিয়া মাছ রান্না হয়েছে। তবে সেখানে তিনি কোনো উচ্চবাচ্য করলেন না।
পুষ্প এই দুই পরিবারেরই বড় মেয়ে। পরিবারে সবচে বড় মেয়েকে কখনো ঠিক বড় মনে হয় না। মনে হয় সে ছোটই রয়ে গেছে। পুষ্প সম্পর্কে এই ধারণা আরো কিছুদিন থাকত, তবে এখন আর নেই। পুষ্প রিহার্সেলে রোজ শাড়ি পরে যাচ্ছে। শাড়ি পরলেই মেয়েটাকে তরুণীর মত দেখায়।
পুষ্পের বাবা এজাজুদিন ভেবেছিলেন দু’এক দিনের ব্যাপার। এখন মনে হচ্ছে দু একদিনের ব্যাপার না। রোজই যাচ্ছে। ওরা অবশ্যি গাড়ি করে নিয়ে যাচ্ছে দিয়ে যাচ্ছে। এবং দোতলায় ভাড়াটে মেয়েটাও যাচ্ছে। তবু একটা অস্বস্তি থেকেই যায়। স্বভাব-চরিত্রে কোনো দাগ পড়ে গেলে মুশকিল।
এজাজুদিন স্ত্রীকে ক’দিন ধরেই এই কথাটা বোঝাতে চেষ্টা করছেন। গম্ভীর গলায় বলছেন, একটা দাগ পড়ে গেলে মুশকিল। দাগ তো শরীরের কোনো অসুখ না যে থুজ টু হানড্রেড দেব আর রোগ আরাম হবে।
এজাজুদিন সাহেবের স্ত্রী মমতা তার স্বামীর কোনো মমতাকেই তেমন পাত্তা দেন না। মেয়ের নাটক করার ব্যাপারে তার সায় আছে। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হয়েও আছে। কেন আছে এই ব্যাপারটা ঠিক পরিষ্কার নয়। এক’দিন তিনি মেয়ের অভিনয়ও দেখে এলেন। মেয়েকে শুধু বললেন, ছেলেটার গায়ের উপর এমন লেপ্টে পড়ে যাওয়ার দরকার কী? একটু দূরে দূরে থাক।
পুষ্প বলেছে, আচ্ছা।
মমতা বলেছেন, যখন ছেলেটা হাত ধরবে, তখন হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিবি। যে বউয়ের দিকে ফিরেও তাকায় না, খালি বই লেখে–তার সঙ্গে এত কি মাখামাখি? বুঝলি, হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিবি।
পুষ্প হেসে বলেছে, আচ্ছা।
তোর স্বামী হয়েছে যে, ঐ ছেলেটা কে?
তার নাম আসিফ।
বিয়ে করেছে?
হুঁ।
বউকে তো দেখলাম না।
উনি এখন আসেন না। শরীর ভাল না।
দেখতে কেমন?
খুব সুন্দরী। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়।
ছেলেটির স্ত্রী খুবই সুন্দরী, এটা শোনার পর মমতার দুশ্চিন্তা পুরোপুরি চলে যায়। থিয়েটারের লোকগুলিকে তাঁর ভালই লাগে। বিশেষ করে মেয়েগুলিকে। এর মধ্যে একজন–যে মায়ের ভূমিকা করে তাকে তাঁর খুবই মনে ধরল। দেখেই মনে হয় শক্ত ধরনের মহিলা। এরকম শক্ত ধরনের মহিলা থাকলে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। মমতা পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হলেন। মহিলাকে বললেন, আমার মেয়েটাকে একটু চোখে চোখে রাখবেন। সেই মহিলা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, সে কি, আী মেয়ে তো আমারও মেয়ে। মমতা বড় শান্তি পেলেন।
পুষ্প যে পরিবার থেকে এসেছে, সেই পরিবারের সদস্যরা কোনো কিছুই নিয়েই তেমন মাথা ঘামায় না। এতগুলি ছেলেমেয়ে যেখানে বড়ো হয় সেখানে কারো ওপর তেমনভাবে নজর রাখা যায় না। কেউ অন্যায় কিছু করলেও তা মনে থাকে না। এজাজুদিন সাহেব এক’দিন দেখলেন এ বাড়ির এক ছেলে রাস্তায় পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফকছে। তিনি রাগে কাঁপতে কাঁপিতে বাড়ি ফিরে এলেন। অপরাধী কে তা তিনি ঠিক ধরতে পারলেন না। কে ছিল? বাবলু না মহিন? অনেকক্ষণ হৈচৈ করার পর তার রাগ কমল।
পুষ্প হৈচৈ কান্নাকাটি করে থিয়েটারে যোগ দেবার ব্যবস্থা করেছে। প্রথমে ব্যাপারটায় সবার খুব আপত্তি থাকলেও এখন মনে হচ্ছে কারোর মনেই নেই। পুষ্পর চাচা এক’দিন রাতে গাড়ি থেকে নামতে দেখে অবাক হয়ে বললেন, কোথেকে আসছিস?
পুষ্প বলল, থিয়েটার থেকে।
থিয়েটার। কিসের থিয়েটোর?
ভুলে গেছেন চাচা? আমি একটা নাটক করছি না?
নাটক, কবে?
সামনের মাসে।
ও আচ্ছা। রাত-বিরাতে ফিরতে হয় নাকি? এটা তো ভাল কথা না। দশটা বাজে। দশটা পর্যন্ত নাটক করলে পড়বি কখন?
এই নাটকটিা করে আর করব না। চাচা।
গুড। ভেরি গুড।
রিহার্সেল থেকে পুষ্প সব সময় হাসিখুশি হয়ে ফেরে। আজ তার মুখটা কালো। যেন বিরাট কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে। অথচ রিহার্সেলে তার সময়টা খুব ভাল কেটেছে। আজমল নামের একজন ভারিক্কি ধরনের লোক তাকে অনেক মজার মজার কথা বলেছে। সেই সব কথার মধ্যে একটা হচ্ছে, এই মেয়ে, ফস করে কাউকে বিয়ে করে বসবে না। তাহলে নাটক মাথায় উঠবে। তোমার অভিনয় খুব ভাল হচ্ছে। কিছুদিন পর দেখবে পথে বের হতে পারবে না। অটোগ্রাফ অটোগ্রাফ বলে লোকজন মাথা খারাপ করে দেবে। অটোগ্রাফ কি করে দিতে হয় সেটাও শিখে নাও। খুব সহজ একটা সিগনেচার তৈরি কর, যাতে খুব দ্রুত অটোগ্রাফ দিতে পার। কালো চশমা পরা অভ্যেস করতে হবে। যাতে লোকজন চট করে চিনতে না পারে।
লীনা আপাও তার সঙ্গে অনেক কথা বললেন। গায়ে হাত রেখে এত আন্তরিকভাবে কথা বললেন যে, তার চোখ প্রায় ভিজে উঠল। রিহার্সেল পুরোপুরি শেষ হবার পর সবাই মিলে যখন চা খাচ্ছে তখন তাকে বললেন, তোমার জন্যে কি কিছু আনতে হবে পুরুপ? আমি ইন্ডিয়া যাচ্ছি। তোমার পছন্দের কোনো জিনিস। যদি থাকে তাহলে বল, আমি অবশ্যই নিয়ে আসব। তবে খুব দামি কিছু আনতে বলবে না। আমার হাতে তেমন টাকা পয়সা নেই।
পুষ্প বলল, আমার জন্যে চন্দন কাঠের একটা পুতুল আনবেন।
অবশ্যই আনব।
আপনি কতদিন থাকবেন?
শুরুতে কথা হয়েছিল দশদিনের। এখন শুনছি। এক মাসের প্রোগ্রাম হচ্ছে। তবে আমি এতদিন কাটাব না। তোমাদের নাটকের আগে অবশ্যই ফিরে আসব।