জানি না কবে। বউ দৌড়াদৌড়ি করছে, সে-ই জানে?
স্ত্রীর কথা বলতে গিয়ে আজমল ভ্রূ কুঞ্চিত করল। লীনা হাসি মুখে বলল, ভাবীর সঙ্গে আবার ঝগড়া হয়েছে?
হুঁ।
এবার কি নিয়ে ঝগড়া করলেন?
তার ধারণা আমি কোনো কিছুই দেখি না। শুধু নাটক নিয়ে থাকি।
ধারণা কি ভুল?
অবশ্যই ভুল। নিয়মিত ক্লাস করি। প্রাইভেট টিউশনি করি, প্রতিদিন সকালে বাজার করি। এরচে বেশি কোন পুরুষটা কি করে? ঝগড়া করার জন্যে অজুহাত দরকার, এটা হচ্ছে একটা অজুহাত। ঐ যে সিংহ-ছাগল ছানার গল্প। সিংহ বলল, ব্যাটা তুই জল ঘোলা করছিস কেন?…
লীনা বলল, আপনি মনে হচ্ছে ভাবীর ওপর খুব রেগেছেন।
রাগব না? অফকোর্স রাগব।— ভাবী, এটাই কি নতুন মেয়ে নাকি? বাহ, অভিনয় তো খুব ভাল করছে। একসেলেন্ট–নাম কি?
পুষ্প।
মনটা খারাপ হয়ে গেল ভাবী।
কেন?
এই মেয়েকে বেশিদিন ধরে রাখা যাবে না। টেলিভিশন ছোঁ মেরে নিয়ে নেবে, তারপর আসবে ফিল্মের লোকজন। আর তা যদি নাও আসে মেয়েটির অভিনয় দেখে কোনো একজন ছেলে তার প্রেমে পড়বে। বিয়ে হয়ে যাবে। বিয়ের পর ঐ ছেলে আর মেয়েটিকে অভিনয় করতে দেবে না। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল ভাবী। খুবই খারাপ। মেয়েটার কি নাম বললেন?
পুষ্প।
আমি নিজেই তো মনে হচ্ছে প্রেমে পড়ে যাচ্ছি। মাই গড়, দারুণ মেয়ে তো!
লীনা খিলখিল করে হেসে ফেলল। স্টেজ থেকে বিরক্ত চোখে আসিফ তাকাচ্ছে। লীনা হাসি বন্ধ করার জন্যে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বারান্দায় চলে গেল। তার এই জাতীয় হাসোহাসির মূল কারণ হচ্ছে যখনই গ্রুপে কোনো নতুন মেয়ে আসে, আজমল সবাইকে বলে বেড়ায় যে এই মেয়েটির প্রেমে পড়ে গেছে।
আসিফ লীনাকে নিয়ে রিকশা করে ফিরছে। জলিল সাহেব একটা পিক-আপ নিয়ে এসেছিল। তিনি লিফট দিতে চাইলেন। আসিফ রাজি হল না। বৃষ্টিতে আধভেজা হয়ে বাড়ি ফেরার নাকি আলাদা একটা মজা আছে।
বৃষ্টি অবশ্য থেমে গেছে। তবে আকাশে মেঘের ঘনঘটা। বিজলি চমকাচ্ছে। ব্যাঙ ডাকছে। ঢাকা শহরে এখনো ব্যাঙ আছে। এবং বৃষ্টি দেখলে এরা ফুলিয়ে ডাকে–এটাই একটা আশ্চর্যজনক ঘটনা। লীনা বলল, ব্যাঙ ডাকছে, শুনছ?
হ্যাঁ শুনছি।
গ্ৰাম গ্ৰাম লাগছে না?
কিছুটা।
এত বড় শহর হয়েও ঢাকার মধ্যে ব্যাপারটা রয়েই গেল!
হ্যাঁ। আজিমপুরের কাছে যারা থাকে। তারা শেয়ালের ডাকও শোনে। ঐ দিকটায় এখনো শেয়াল আছে।
খানাখন্দ ভরা রাস্তা। রিকশা খুব ঝাকুনি দিচ্ছে। আসিফ ডান হাত দিয়ে লীনাকে জড়িয়ে ধরল। লীনার গা একটু যেন কেঁপে উঠল। সে নিজে এতে খানিকটা অবাকও হল। এত দিন পরেও আসিফ তার গায়ে হাত রাখলে গা কেঁপে ওঠে। মনটা তরল ও দ্রবীভূত হয়ে যায়। কোথেকে যেন উড়ে আসে খানিকটা বিষন্নতা।
আসিফ বলল, শীত লাগছে লীনা?
না।
পুষ্পের অভিনয় কেমন দেখলে?
ভাল, খুব ভাল। কল্পনা করা যায় না। এমন ভাল।
আসলেই তাই।
লীনা খানিক্ষণ ইতস্তত করে বলল, ও যে কেন এত ভাল অভিনয় করছে তা কি তুমি জান?
আসিফ গম্ভীর গলায় বলল, জানি।
বল তো কেন?
ধাঁধা।
হ্যাঁ, ধাঁধা। বলতে পারলে তোমার জন্যে পুরস্কারের ব্যবস্থা আছে।
কি পুরস্কার?
লীনা ইংরেজিতে বলল, ঝড়-বৃষ্টির রাতে যে ধরনের পুরস্কারে পুরুষরা সবচে বেশি আনন্দিত হয়। সেই পুরস্কার।
আসিফ সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে সহজ গলায় বলল, মেয়েটা খুব ভাল অভিনয় করছে, কারণ সে আমার প্রেমে পড়ে গেছে। ধাঁধার জবাব কি ঠিক হয়েছে লীনা?
লীনা বেশ খানিক্ষণ চুপ থেকে বলল, হ্যাঁ ঠিক হয়েছে। ব্যাপারটা তুমি কখন টের পেলে?
প্রথম দিনেই টের পেলাম। অভিনয়ের এক পর্যায়ে তার হাত ধরতে হয়। হাত ধরেছি, হঠাৎ দেখি থারথার করে তার আঙুলগুলি কাঁপছে।
ভয় থেকেও কাঁপতে পারে। নার্ভাসনেস থেকেও পারে।
তা পারে। তবে এতদিন হয়ে গেল অভিনয় করছে, এখনো তার হাত ধরলে এরকম হয়।
লীনা চুপ করে রইল। আসিফ হেসে বলল, একই ব্যাপার। কিন্তু তোমার বেলায়ও ঘটে। হাত ধরলে তুমিও কেঁপে ওঠ। তুমি নিজে বোধ হয় তা জানো না। নাকি জান?
লীনা গাঢ় স্বরে বলল, জানি।
লীনা আসিফকে কথা শেষ করতে দিল না। কথার মাঝখানেই বলল, আজিমপুরের দিকে সত্যি সত্যি শেয়াল ডাকে নাকি? এক’দিন শেয়ালের ডাক শোনার জন্যে যেতে হয়। অনেক’দিন শোনা হয়নি।
তুমি ইন্ডিয়া থেকে ঘুরে আস, তারপর এক’দিন যাব।
আসিফ বা হাতে লীনার হাত মুঠো করে ধরল। লীনার আঙুল কেঁপে উঠল। আসিফ লীনার দিকে না তাকিয়েই তরল গলায় হাসল।
পুষ্প থাকে পুরনো ঢাকায়
পুষ্প থাকে পুরনো ঢাকায়।
চানখাঁর পুল থেকে ভেতরের দিকে যেতে হয়। বিরাট দোতলা বাড়ি। উপরের তলা ভাড়া দেয়া। নিচের তলায় ভাগাভাগি করে পুতপরা থাকে এবং পুতেপর বড়চাচা থাকেন। পুষ্পের বাবা এবং বড়চাচা দুজনেই ওকালতি করেন। দুজনেরই পসার নেই। পুষ্পের বাবা এজাজুদ্দিন ওকালতি ছাড়াও হোমিওপ্যাথি করেন। হোমিওপ্যাথিতে তার কিছুটা পসার আছে। লোকজন বাসায় এসে ভিজিট দিয়ে ব্যবস্থা পত্র নেয়।
পুষ্পদের বাসায় অনেকগুলি ভাইবোন। নিজের এবং চাচাতো বোনদের সংখ্যা সাত। ভাই ছজন। এরা রাতে কে কোথায় ঘুমায় কোনো ঠিক নেই। প্রায়ই দেখা যায় অনেক রাতে একজন পড়াশোনা শেষ করে উঠেছে। কোথায় ঘুমাবে জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছে।
রান্না দুবাড়িতেই আলাদাভাবেই হয়, তবে কে কোন বাড়িতে খাবে তারও কোনো ঠিক নেই। পুম্পের বড়চাচা খলিলুদ্দিন বেশির ভাগ সময়ই পুষ্পদের সঙ্গে খান। নিজের স্ত্রীর রান্না তিনি খেতে পারেন না। খেতে বসে বেশির ভাগ সময়ই খুব অপমানসূচক কথা বলেন। আজ তাই বলছেন। আজ রান্না হয়েছে তেলাপিয়া মাছ। তিনি মুখে দিয়েই থু করে ফেলে দিলেন। এবং থমথমে গলায় বললেন, জিনিসটা কি?