কি করলেন?
ভদ্রলোকের স্ত্রীকে টেলিফোন সমস্ত ব্যাপারটা বললাম।
তারপর?
তারপরের কথা কিছু জানি না।
আপনার বিল? আপনার বিলের কি হল?
ঐসব এখন জানতে চাওয়া কী অর্থহীন না?
ফরহাদ সাহেব খাবার মুখে দিচ্ছেন। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তিনি ঘাস চিবুচ্ছেন। অনেক কষ্টে কুৎসিত কিছু গিলে ফেলার চেষ্টা করছেন। খানিক্ষণ পর পর পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে গলা ভিজিয়ে নিচ্ছেন।
আসিফ।
জি।
মনটা খুব অস্থির। কোনো কিছুই ভাল লাগে না। অফিসে বসে সারাদিন শুধু ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাই। নাটক-ফাটক দেখলে মনটা ভাল হবে নাকি বল তো? ভাল কিছু কি হচ্ছে?
আসিফ জবাব দিল না।
ফরহাদ সাহেব বললেন, রিয়েল ওয়ার্লড থেকে আনরিলে ওয়ার্লডে খানিক্ষণের জন্যে হলেও ঢুকতে ইচ্ছে করে। টিপু সুলতান, সিরাজদ্দৌলা এইসব নাটক কি আজকাল হয়, আসিফ?
মফস্বলের দিকে হয়।
তোমরা কর না কেন? ফ্যান্টাসি ধরনের জিনিস দেখতে ইচ্ছা করে। মশিয়ে লালী, নানা ফারনাবিশ, ভেরি ইন্টারেস্টিং, তাই না? তারপর একটা মেয়ে ছিল না? যে বলল–আমার বাপুজী জৌতিষ চর্চা করেন। টিপু সুলতান বলল, কে তোমার বাপুজী, কি তার পরিচয়? মেয়েটি বলল, বাপুজীকে আপনার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন তার গণনায়।
আসিফ বলল, দুলাভাই আপনার মনে হয় খানিকটা নেশা হয়ে গেছে।
ফরহাদ সাহেব সঙ্গে সঙ্গে বললেন, হ্যাঁ হয়েছে। আমি নিজেই বুঝতে পারছি। অভ্যাস নেই। তার ওপর গরমটাও পড়েছে প্রচণ্ড। অল্পতেই …চল উঠে পড়ি।
আপনি তো কিছুই খেলেন না।
ইচ্ছা করছে না। টেস্টলেস সব খাবার। মনে হচ্ছে মানুষের বমি খাচ্ছি। ভাল কথা, বমির ইংরেজি কি জানো না কি? কয়েক’দিন ধরেই ভাবছি কাউকে জিজ্ঞেস করব।–মনে থাকে না।
গাড়িতে উঠে ফরহাদ সাহেব আরো ঝিম মেরে গেলেন। আসিফ বলল, দুলাভাই আপনি কি গাড়ি চালাবেন?
ইয়েস। ভয় নেই, এক্সিডেন্ট করব না। স্টিয়ারিং হুইল ধরামাত্র আমি সোবার হয়ে যাই। তাছাড়া ধর এক্সিডেন্ট যদি করেই ফেলি, তেমন কী আর হবে?
গাড়িতে উঠে ফরহাদ সাহেব সত্যি সত্যি সোবার হয়ে গেলেন। সহজভাবে গাড়ি চালাতে লাগলেন। হাসিমুখে বললেন, ভয় কমেছে?
কমেছে।
আসিফ, তোমার জন্যে আমি একটা ব্যবস্থা করে দেব। চিন্তা করবে না। আমাকে খানিকটা সময় দাও–ধর মাস খানিক।
থ্যাংকস দুলাভাই।
কোথায় যাবে বল, তোমাকে নামিয়ে দিই।
যে কোনো এক জায়গায় নামিয়ে দিলেই হবে। আমার বিশেষ কোথাও যাবার প্রোগ্রাম নেই।
ফরহাদ সাহেব গাড়ি পার্ক করলেন। আসিফ নেমে পড়ল। ফরহাদ সাহেব বললেন, এক সেকেন্ডের জন্যে দাঁড়াও। তোমার সঙ্গে কিছু মিথ্যা কথা বলা হয়েছে। সত্যি কথাটা বলে ফেলি।
কোন বিষয়ে?
আমি ঐ লোকের স্ত্রীকে টেলিফোন করিনি। ভদ্রলোক যেমন চেয়েছেন সেই মতো ব্যবস্থা হয়েছে। গত পরশু আমি বিল পেয়েছি। যাই, কেমন?
ফরহাদ সাহেব গাড়ি নিয়ে ছুটে বের হয়ে গেলেন। রাস্তায় যানবাহনের জটলা, কিন্তু তার গাড়ি দ্রুত চলছে। আসিফ লাল রঙের গাড়িটির দিকে তাকিয়ে রইল।
একজন মানুষের সঙ্গে অন্য একজন মানুষের সম্পর্কের ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। আসিফ নিজের আত্মীয়-স্বজন কারের সঙ্গেই কেমন যেন সহজ হতে পারে না। অদৃশ্য একটা পর্দা থেকেই যায়। অথচ এই মানুষটিকে খুবই আপন মনে হয়। যদিও আসিফের বোনের সঙ্গে এই লোকটির তেমন অন্তরঙ্গতা বিয়ের এত বছরেও তৈরি হয়নি। কুৎসিত সব ঝগড়া।
অন্য বোনদের সঙ্গে তাদের স্বামীদের ভাব-টাব কেমন আসিফ জানে না। অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই বললেই হয়। মা বেঁচে থাকতে খানিকটা যোগাযোগ ছিল। মা পালা করে একেক মেয়ের বাসায় থাকতেন। ঈদ উপলক্ষে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে বোনদের সঙ্গে দেখা হত। বোনরা কড়া কড়া কথা শোনোত, যার মূল ভাব একটিই. আসিফ ভয়াবহ একটা চরিত্র। আসিফের মেজো বোন একটি কথা প্রায় সরাসরি বলে, বাবা এত সকাল মরে গেল। শুধু আসিফের কারণে। আসিফ বাবাকে কষ্ট দেয়ার জন্যেই ইচ্ছা করেই পড়াশোনা ছেড়ে দিল। নয়ত যে ছেলে ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষায় ডিসট্রিক্ট ফাস্ট হয়, সে কি করে মেট্রিক প্রথমবারে ফেল করে দ্বিতীয়বারে থার্ড ডিভিশনে পাস করে, আইএ তে কম্পার্টমেন্টাল পায়! বাবা মরে গেল। এই দুঃখে।
যে কোনো কথাই অনেকবার শুনলে সেটাকে সত্যি মনে হয়। রেসকোর্সের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এই মুহূর্তে আসিফের মনে হচ্ছে মেজো। আপার কথা সত্যি হলেও হতে পারে। বৈশাখ মাসের দুপুরে হাঁটতে হাঁটতে সে খানিকটা বিষন্ন বোধ করল। তার মনে হল সব মানুষের অন্তত একবার করে হলেও জীবন গোড়া থেকে শুরু করবার সুযোগ থাকলে ভালো হত। বড় ধরনের ভুলগুলির একটি অন্তত শোধরানো যেত।
তার সবচেয়ে বড়ো ভুল কোনটা? নাটক? আর লীনা? লীনাও কি তার মত বড়ো কোনো ভুল করেছে? একবার তাকে জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়?
আসিফ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। প্রচণ্ড পানির পিপাসা হচ্ছে। আশপাশে পানি খাবার কোনো ব্যবস্থা নেই। ঢাকা শহরের নানান জায়গায় এখন চমৎকার ফোয়ারা। এই সব ফোয়ারার পানি কি খাওয়া যায়? প্রেসক্লাবের কাছের ফোয়ারার পানি একবার এক তৃষ্ণার্তা খুব আগ্রহ করে খেতে দেখেছিল। বৃদ্ধের চেহারা বেশ সম্রােন্ত। হাতে মেডিকেল রি.ে তাঁর লোকদের মত চামড়ার ব্যাগ। সেই এই ব্যাগ রেখে ফোয়ারার পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে বেশ আয়োজন করে পানি খেল। দৃশ্যটা আসিফের এতই মজা লাগল যে এগিয়ে গেল। বৃদ্ধ খুব আন্তরিক ভঙ্গিতে আসিফকে বললেন, সরকার পানি খাওনের ভাল ব্যবস্থা করেছে। খুবই উত্তম ব্যবস্থা!