জলিল সাহেবের কথা শেষ হল না, তার আগেই একেকজন হাসতে হাসতে ভেঙে পড়েছে।
লীনা বলল, মিজান, ওরা হাসাহসি করছে কি নিয়ে জানো?
মিজান বলল, জলিল সাহেব আজেবাজে গল্প বলেন, ঐ নিয়ে হাসোহাসি হয়।
আজেবাজে গল্প মানে কি রকম গল্প?
বাদ দেন তো ভাবী।
জলিল সাহেবের গল্প আরো খানিকটা অগ্রসর হয়েছে। আবার সবাই হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ছে। ঘরের ভেতর খুব গরম লাগছে। লীনা বারান্দায় চলে এল; বারান্দা থেকেই দেখল মেয়েরা সব চলে এসেছে। মেয়েদের আনার জন্যে একটা গাড়ি যায়। নতুন মেয়েটির আজ আসার কথা, সে এসেছে কি না কে জানে।
মজনু চা বানাচ্ছে। প্রথম কাপটা সে লীনার দিকে বাড়িয়ে দিল।
লীনা বলল, চা খাব না রে।
গরম লাগছে?
ঠাণ্ডা কিছু আইন্যা দিমু?
না।
আফনের শইলডা কি খারাপ আফা?
না-শরীর খারাপ না।
লীনা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তার শরীরটা আসলেই খারাপ। কেন খারাপ তা সে নিজেও ঠিক জানে না। রাতে ঘুম ভাল হচ্ছে না। একবার ঘুম ভাঙলে কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না! কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়।
যে চার জন মেয়ে এসেছে তাদের একজন আজই প্রথম এল। শ্যামলা একটি মেয়ে, মুখ থেকে বালিকা ভাবটা এখনো যায়নি। সে অবশ্য লালমাটিয়া কলেজে আই.এ. পড়ছে। এবার সেকেন্ড ইয়ার। ভাল নাম ইসরাত বেগম। সবাই অবশ্যি তাকে পুষ্প পুষ্পা ডাকছে।
মেয়েটিকে দেখে মনে হচ্ছে সে খুব লজ্জা পাচ্ছে, তবে কৌতূহলী চোখে চারদিক দেখছে।
সে একা পড়ে গেছে। অন্য মেয়েরা জলিল সাহেবের কাছে চেয়ার টেনে বসেছে। জলিল সাহেব ভূতের গল্প শুরু করেছেন। ভূতের গল্পগুলি অবশ্যি আদিরসের গল্পের মত জমছে না।
লীনা বারান্দা ছেড়ে আবার ঘরে ঢুকল। পুষ্পের পাশে চেয়ারে এসে বসল। হাসি মুখে বলল, নাম কি তোমার?
পুষ্প।
বাহ খুব ভাল নাম।
বলে লীনা নিজেই একটু লজ্জা পেল। বাহ খুব ভাল নাম তো। এই জাতীয় কথাগুলি সাধারণত ছোট বাচাদের বলা হয়। এই মেয়েটি ছোট বাচ্চা নয়।
তুমি কি আগে অভিনয় করেছ?
জি না। আমি হয়ত পারব না।
কেন পারবে না। নিশ্চয়ই পারবে। অভিনয় কঠিন কিছু নয়। আমি যদি পারি তুমিও পারবে।
বাসা থেকে করতে দেবে কি না তাও তো জানি না।
সেকি। বাসায় কাউকে কিছু বলনি?
জি না।
বলনি কেন?
বাসায় বললাম, তারপর এখানে কিছু পারলাম না, আপনারা বাদ দিলেন…
লীনা খানিকটা অবাক হল। এই মেয়েকে যতটা লাজুক শুরুতে মনে হচ্ছিল, এ ততটা লাজুক নয়। গলার স্বর পরিষ্কার ও স্পষ্ট। এ পারবে। লীনা বলল, আমাদের দিকটাও কিন্তু তুমি দেখনি। ধরা যাক আমরা তোমাকে নিলাম, তারপর বাসা থেকে বলল… হবে না। তখন আমরা ঝামেলায় পড়ব না?
আমি আপনাদের দিকটা ভাবিনি, আমি শুধু আমার নিজের দিকটাই ভেবেছি।
সবাই তাই ভাবে পুষ্প।
নাটক পরিচালক বজলু ভাই এসে ঢুকেছে। আজ তিনিও দেরি করেছেন। অসম্ভব রোগা, অসম্ভব কালো এবং প্রায় ছফুটের মত লম্বা একজন মানুষ। খানিকটা কুজো হয়ে হাঁটেন বলে তাঁর অন্য নাম হচ্ছে হাঞ্চ ব্যাক অব মীরপুর।
বজলু ভাই এসেই বিরক্ত স্বরে বললেন, তোমরা বসে আছ কেন? শুরু করে দিলেই হত।
জলিল সাহেব বললেন, আপনি নেই, শুরু করব কি ভাবে?
আমি না থাকলে শুরু হবে না। এটা কেমন কথা?
আসিফ ভাইও এখনো আসেননি।
বল কি? এদের হয়েছে কি? দেখি চা দিতে বল। চা খেয়ে ম্যারাথন। আজ ফুল রিহার্সেল হবে। নতুন মেয়ে একটা আসার কথা। এসেছে? কুসুম কিংবা পুষ্প এ জাতীয় নাম।
পুষ্প উঠে দাঁড়াল। বজলু সাহেব সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন। পুষ্প খুব অস্বস্তি বোধ করছে। এতক্ষণ কেউ তেমন করে তার দিকে তাকায়নি, এখন একসঙ্গে সবাই তাকাচ্ছে।
তোমারই নাম কুসুম?
আমার নাম পুষ্প।
একই ব্যাপার। তৈলাধার পাত্র কিংবা পাতাধার তৈল-অভিনয় করেছ কখনো?
জি না।
এই তো একটা ভুল কথা বললে,-অভিনয় তো আমরা সারাক্ষণই করছি। করছি না? বাড়িতে মেহমান এসেছে, তুমি খুব বিরক্ত, তবু তার সঙ্গে হাসি মুখে গল্প করতে হচ্ছে। দেখাতে হচ্ছে যে তুমি আনন্দিত। এটা অভিনয় না? অভিনয় তো বটেই। কঠিন অভিনয়। আমাদের প্রতিনিয়ত অভিনয় করতে হয়।
পুষ্প তাকিয়ে আছে। এই লোকটিকে তার পছন্দ হচ্ছে না। কথা বলার সময় লোকটির মুখ থেকে থুথু ছিটকে আসছে। আর কথা বলছে কেমন মাস্টারের ভঙ্গিতে। কথাবার্তায় একটা সবজান্তা ভাবা এই রকম সবজান্তা লোক তার ভাল লাগে না।
পুষ্প।
জি।
তুমি একটা কাজ কর। একটু দূর থেকে হেঁটে হেঁটে এখানে এসে দাঁড়াও। তারপর তুমি তোমার মাকে ডাক। এমন ভাবে ডাকবে যেন তাকে তুমি জরুরি খবর দিতে চাচ্ছি।
কি খবর?
মনে কর একটা দুঃসংবাদ।
পুষ্প তাই করল। যদিও তার মোটেও ভাল লাগছে না। একটু দূর থেকে হেঁটে এসে বলল, মা, মা।
বজলু সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, কিছুই তো হল না, আবার কর।
পুষ্পের মুখ লাল হয়ে গেছে। সে একবার ভাবল কিছু করবে না। দাঁড়িয়ে থাকবে। কিন্তু তা কী ঠিক হবে? সবাই তার দিকে তাকাচ্ছে। পুষ্প আবার একটু দূরে সরে গেল। এগিয়ে এল জড়ানো পায়ে। আবার ডাকল। মা, মা।
বজলু সাহেব ভ্রূ কুঁচকে বললেন, রোবটের মত কথা বলছ। ফ্রিলি বল। পরিষ্কার গলায় বলল। জায়গাটা আবার কর।
পুষ্প বলল, আর করব না, আমার ইচ্ছে করছে না।
ইচ্ছে করছে না। মানে?
আমি অভিনয় করব না।
পুষ্প লীনার পাশের চেয়ারটায় বসে পড়ল। তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। কি রকম বিশ্ৰী ভঙ্গিতে লোকটা বলল.কিছুই তো হল না। কিছুই না হওয়াটা যেন তার অপরাধ।