সবচে কঠিন বক্তব্যের নাটকেও আছে রিলিফের ব্যবস্থা। কুইনাইন সরাসরি গেলা যায় না। মিষ্টি চিনির প্রলেপ দিয়ে দিতে হয়।
দুপুর দেড়টার দিকে আসিফ উপস্থিত হল তার বড় দুলাভাইয়ের অফিসে। নিকট আত্মীয়দের মধ্যে অল্প যে কজনের সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে ফরহাদ সাহেব হচ্ছেন তাদের একজন। এক সময় সরকারি চাকুরে ছিলেন। রোডস এন্ড হাইওয়েজের ইঞ্জিনিয়ার। চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখন কনসট্রাকশান ফার্ম দিয়েছেন। সাধারণত ইঞ্জিনিয়াররা ব্যবসা শুরু করলে দ্রুত বড়লোক হয়ে যায়। এর বেলায় ব্যতিক্রম হয়েছে। আগে যা ছিলেন এখন তাই আছেন। কাজকর্ম নাকি তেমন জোগাড় করতে পারেন না। আসিফ যখন তার কাছে আসে, দেখে–তিনি চেয়ারে পা তুলে বসেছেন। হাতে ম্যাগাজিন। দেশী-বিদেশী অসংখ্য ম্যাগাজিন তার টেবিলে থাকে। তিনি সব ম্যাগাজিন গভীর আগ্রহে পড়েন।
ফরহাদ সাহেব মানুষটা ছোটখাটো। বেমানান বিশাল গোঁফ আছে। গোফের আড়ালে ঠোঁট ঢাকা বলে কখন হাসছেন তা বোঝা যায় না, মনে হয়। সারাক্ষণই রেগে আছেন। আসিফকে ঢুকতে দেখে হাতের ম্যগাজিন না নামিয়ে এবং আসিফের দিকে না তাকিয়েই বললেন, টাকা ধার চাইতে এসেছ?
আসিফ বলল, হ্যাঁ।
কত?
লাখ খানিক।
বস। আসিফ বসল। ফরহাদ ম্যাগাজিন নামিয়ে রাখলেন, গোফের আড়ালে হাসলেন। পর মুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে বললেন, কিছু হয়নি এখনো?
না।
হবে বলে কি মনে হচ্ছে?
না হচ্ছে না।
হতাশ?
জি হতাশ। খুব হতাশ?
হ্যাঁ।
দুপুরে খাওয়া হয়েছে?
জি না। চল কোথাও গিয়ে খাই। পেটে খুব ক্ষুধা থাকলে হতাশ ভাবটা বেশি থাকে। জাতি হিসেবেই আমরা হতাশ কেন জানো? হতাশ, কারণ বেশির ভাগ মানুষ ক্ষুধার্তা! বুঝলে?
বুঝলাম।
না বোঝনি। এটাই সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যেখানে ক্ষুধাকে খুব সম্মানের চোখে দেখা হয়। এই দেশের কবি লেখেন, হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান। দারিদ্র্য মানুষকে মহান করে না, পঙ্গু করে ফেলে।
খুবই ফিলসফিক কথাবার্তা বলছেন দুলাভাই।
বলছি, কারণ আমার অবস্থা কাহিল। তোমার বোন সেই খবরটা এখনো জানে না। সে সুখে আছে।
ব্যবসা পাতি খারাপ যাচ্ছে?
ইয়েস। কি পরিমাণ খারাপ, তুমি চিন্তা করতে পারবে না। মোটা এমাউন্টের টাকা ঘুষ দিয়ে একটা কনট্রাক্ট দেই। কাজ শুরু মাত্র সবাই হাঁ করে ফেলে,–প্রতিটি মানুষকে টাকা খাওয়াতে হয়।
যে রাস্তায় ছইঞ্চি বিটুমিন দেওয়ার কথা সেখানে দিই এক ইঞ্চি। প্রথম সেই বিটুমিন ধুয়ে মুছে যায়। আবার টেন্ডার হয়। আবার টাকা খাওয়াখাওয়ি। তুমি করাংলাদেশে কোথাও কোন সৎ মানুষ নেই। সৎ মানুষ এখন আছে কোথায় জানো? গল্প, উপন্যাস এবং তোমাদের নাটকে।
ফরহাদ সাহেব আসিফকে নিয়ে দামি একটা রেস্টুরেন্টে গেলেন। নতুন রেস্টুরেন্ট, বিদেশীরাই বেশির ভাগ ভিড় করছে। রেস্টুরেন্টের বিশেষত্ব হচ্ছে সঙ্গে বার আছে। ফরহাদ সাহেব খাবারের অর্ডার দিয়ে পর পর ছপেগ হুঁইস্কি খেয়ে চোখ লাল করে ফেললেন। আসিফ অবাক হল। ফরহাদ সাহেবের এই ব্যাপারটা তার জানা ছিল না। ভাল মানুষ ধরনের লোক ছিলেন। তার ব্যবহার এবং স্বভাব চরিত্রের সঙ্গে দুপুরবেলায় মদ্যপানটা ঠিক মানাচ্ছে না।
ফরহাদ সাহেব বললেন, আসিফ তোমরা নাটক কেন কর?
আসিফ কিছু বলল না। ফরহাদ সাহেব মুখ খানিকটা এগিয়ে এনে উত্তেজিত গলায় বললেন, পত্রিকা ওল্টাতেই দেখি গ্রুপ নাটকের মটো হচ্ছে–আমরা নাটক করি সমাজ বদলাবার জন্যে। এইসব ফালতু কথা তোমরা কেন বল? মহিলা সমিতির ফ্যানের নিচে দেড় ঘণ্টার একটা নাটক করে তোমরা সমাজ বদলে ফেলবে? সমাজ কোথায় আছে তোমরা জানো?
আসিফ হাসল। ফরহাদ সাহেব থমথমে গলায় বললেন, হেসে ফেললে? আমি কি খুব হাস্যকর কিছু বলেছি? আমার দৃঢ় বিশ্বাস সমাজ কোথায় আছে তোমরা জানো না।
আপনি জানেন? কিছুটা জানি। মাঝে মাঝে প্রচুর মদ্যপান যখন করি তখন কিছুটা ইনসাইট ডেভেলপ করে। ফরহাদ সাহেব আরো এক পেগের অর্ডার দিলেন। আসিফ একবার ভাবল বলবে–দুলাভাই বেশি হয়ে যাচ্ছে।
কিছু বলল না। ফরহাদ সাহেব গলা নিচু করে বললেন, থিয়েটার-ফিয়েটার করা। তোমার সন্ধানে সতেরো-আঠারো বছরের কচি মেয়ে আছে? যে সাতান্ন আটান্ন বছরের একজন বুড়োর সঙ্গে কোনো একটা ভালো হোটেলে এক রাত থাকবে? আছে এরকম কিছু তোমার সন্ধানে?
দুলাভাই, আপনি কি বলছেন, কিছু বুঝতে পারছি না।
বুঝতে পারবে না জানি। বুঝিয়ে দিচ্ছি। আমার আঠারো লাখ টাকার, একটা বিল আটকে আছে। আটকেছে মাত্র এক জায়গায়। যেখানে আটকেছে সেখানে যিনি আছেন তার বয়স সাতান্নআটান্ন। তিনি আমাকে ডেকে বলেছেন, লাইফ খুব ডাল হয়ে যাচ্ছে–এটাকে ইন্টারেস্টিং করার একটা ব্যবস্থা করতে পারেন?
আমি বললাম, নিশ্চয়ই পারি।
উনি বললেন, আমাকে বলতে একটু ইয়ে লাগছে…
আমি বললাম, আপনি কোনোরকম সংকোচ করবেন না। স্যার। তখন উনি বললেন, আজকাল শুনতে পাই ভেরি ইয়াং গার্লস, অনেক এ্যাডভেঞ্চারের লোভে হোটেলে হোটেলে রাত কাটাচ্ছে…বুঝতে পারছেন কি মিন করছি?
আমি বললাম, পারছি।
তিনি বললেন, জাস্ট একটা এক্সপেরিয়েন্সের জন্যে। পারা যাবে? আমি বললাম, অবশ্যই এটা কোনো ব্যাপারই না।
আসিফ বলল, আপনি কি কোনো ব্যবস্থা করলেন?
ফরহাদ সাহেব বললেন, আমি কি করলাম শোন, অফিসে এসে দরজা বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইলাম। আমার মেঝ মেয়ে সুমি.ওর বয়স সতেরো। চোখের সামনে একটা ছবি ভেসে উঠল, যেন সুমি এই লোকটার কোমর জড়িয়ে হোটেলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। মাথায় আগুন লেগে গেল। কি করলাম জানো?