বজলু সাহেব বললেন, কেরামত আছে?
জি আছেন। এখন একটু ব্যস্ত।
আমিও ব্যস্ত। আপনি দয়া করে বলুন, ভৈরবের বজলু।
মৈনাক পর্বত বিরক্ত ভঙ্গিতে ভেতরে চলে গেল। বজলু আসিফকে নিচু গলায় বললেন, তুমি এখানেই বসে থাক। আমি এক যাই। দরকার হলে তোমাকে ডাকব।
আসিফ বলল, দরকার হবে বলে মনে করছেন?
অবশ্যই হবে। কেরামত আমার কথা ফেলবে না। ওর সেই ক্ষমতাও নেই। এসএম হলে লিটারেলি আমিই ওকে ফেলেছি।
পুরনো কথা কেউ মনে রাখে না বজলু ভাই।
দেখা যাক। আগেই ডিসাহার্টেড হচ্ছে কেন?
বজলু এসেছেন আসিফের চাকরির ব্যাপারে। এসেছেন। খুবই উৎসাহ নিয়ে। তার ধারণা এই মুহূর্তেই একটা কিছু হবে। আসতে আসতে বলেছিলেন, তোমার চাকরি কোনো ব্যাপারই না। যে কোনো অফিসের একজন বসকে ধরে এনে নাটক একটা দেখিয়ে দিলেই ব্যাটেল ইজ ও না।
আসিফ কোনো প্রতিবাদ করেনি। যদিও বলতে চেয়েছিল নাটকের ক্ষেত্রে এটা কখনো হয় না। খেলোয়াড়দের ব্যাপারে হয়। ভাল ফুটবল প্লেয়ার, ক্রিকটে প্লেয়ারদের ডেকে ডেকে চাকরি দেয়। এরা অফিসের শোভা। কিন্তু নাটক করা লোককে কে রাখবে?
মৈনাক পর্বত বজলু সাহেবকে ডেকে নিয়ে গেল। আসিফ বসে রইল। সুন্দরী মেয়েটি বলল, আপনি চা খাবেন?
জি খাব।
মেয়েটি কেমন যেন আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছে। কোনো একটা নাটক কী সে দেখেছে? অসম্ভব কিছু তো নয়। দেখতেও তো পারে। সুন্দরী মেয়েটি নিজেই চায়ের কাপ নিয়ে এগিয়ে এল। মিষ্টি গলায় বলল, আপনি কী মাধবীর ভাই?
জি না।
মেয়েটির সব আগ্রহ শেষ। সে ফিরে গেল নিজের জায়গায়। ব্যস্ত হয়ে পড়ল টেলিফোন নিয়ে। সম্ভবত চা এনে দেয়ায় নিজের ওপরই সে এখন রাগ করছে।
কেরামত যতটা আন্তরিকতা দেখাবে বলে বজলু ভেবেছিলেন, সে তার চেয়েও বেশি দেখাল।–জড়িয়ে ধরে নাচানাচি করল খানিকক্ষণ; গদগদ গলায় বলল, ভৈরবের বজলু যে তুমি তা বুঝতে পারিনি দোস্ত। বিশ্বাস কর। এই টাকা জুয়ে বলছি। ব্যবসায়ী কখনো টাকা ছুঁয়ে মিথ্যা কথা বলে না।
ব্যবসা কেমন চলছে?
টুকটাক। ফাজিলের দেশ। ফাজিলের দেশে ব্যবসা করে সুখ নেই।
তুই তো মনে হচ্ছে সুখে আছিস।
টাকা আছে। মনে শান্তি নাই রে দোস্ত। কি জন্যে এসিছিস বল।
চাকরি দিতে হবে একটা।
এটা ছাড়া আর কিছু বলার থাকলে বল।
আর কিছু বলার নেই।
কেরামত গম্ভীর হয়ে গেল। বজলু সিগারেট ধরালেন। এই ঘরের এয়ার কন্ডিশনার অনেক নিচে সেট করা। বেশ ঠাণ্ডা লাগছে। মনে হচ্ছে ফ্রিজের ভেতর তিনি বসে আছেন। কেরামত বলল, চাকরি। কার?
আমার গ্রুপের একজন।
তোর আবার কিসের গ্রুপ।
নাটকের গ্রুপ।
ও আচ্ছা, এখনো নাটক নিয়ে আছিস? ভাল শিল্প সাহিত্যের কোনো খবর রাখি না। আমার বউ বলছিল মহিলা সমিতিতে ভাল ভাল নাটক হয়। সে এক’দিন দেখে আসল কমেডি ধরনের কিছু হবে। রাতে ঘুমুতে গিয়েও একটু পর পর হেসে ওঠে।
বজলু বললেন, আসল কথা থেকে দূরে সরে যাচ্ছিস।
তোর ক্যান্ডিডেটের যোগ্যতা কি? মানে নাটক ছাড়া আর কি জানে?
বি এ পাস। শুরুতে ব্যাংকে চাকরি করত, তারপর ইস্টার্ন ট্রান্সপোর্টে কিছু দিন ছিল। জীবন বীমাতে কিছুদিন কাজ করেছে।
অচল মাল গছাতে চাচ্ছিস।
বজলু সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, আসিফের মত ছেলেকে চাকরির জন্য মানুষের দরজায় দরজায় ঘুরতে হচ্ছে এইটাই হচ্ছে আফসোসের ব্যাপার। বিলেত আমেরিকা হলে এই ছেলে টাকার ওপর শুয়ে থাকত।
কেরামত বলল, কষ্ট করে কিছু টাকা পয়সা জোগাড় করে এই ছেলেকে বিলেত আমেরিকা পাঠিয়ে দিলেই হয়।
বজলু গম্ভীর হয়ে গেলেন।
কেরামত বলল, ঠাট্টা করলাম রে দোস্ত। তোকে সত্যি কথা বলি বিজনেসের অবস্থা খুবই টাইট। তবু তুই এসেছিস এই খাতিরে আমি যা করতে পারি সেটা হচ্ছে টাইপিস্টের একটা চাকরি দিতে পারি। তবে টাইপ জানতে হবে।
বজলু উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তবু বললেন, তোব এখানে হবে না বুঝলাম। উঠি।
কেরামত বলল, রাগ করে উঠে যাচ্ছিস তা বুঝতে পারছি। উপায় নেই দোস্ত। আমার জায়গায় তুই থাকলে তুইও ঠিক এই কথাই বলতি। পুরনো দিনের খাতিরে এক কাপ চা অন্তত খেয়ে যা। আমি মানুষটা খারাপ হতে পারি। আমার অফিসের চা কিন্তু ভাল।
বজলু চা খেলেন না। অফিস থেকে বের হবামাত্র তার পিঠ আবাবা কুজো হয়ে গেল। তবে বেশ শক্ত গলায় বললেন, তুমি কোনো চিন্তা করবে না। আমি একটা ব্যবস্থা করব। অবশ্যই করব। চল কোথাও বসে চা-টা কিছু খাওয়া যাক।
আসিফ বলল, আমি একটু পুরানা পল্টনের দিকে যাব। এগারোটার মধ্যে না গেলে কাজ হবে না। চা থাক।
চাকরি সংক্রান্ত ব্যাপার?
জি।
আচ্ছা যাও। তবে শোন, বিকেলে রিহার্সেলে আসার সময় অনেক কপি বায়োডাটা নিয়ে আসবে।
দেয়ার মতো বায়োডাটা তো কিছু নেই।
যা আছে তাই আনো না। আমার এক খালু আছেন খুবই হাই লেভেলের লোক। মন্ত্রী লেভেলের লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ। তাকে দিয়েই কাৰ্য উদ্ধার করতে হবে। তুমি একেবারেই চিন্তা করবে না।
জি আচ্ছা।
লীনার শরীর এখন কেমন?
ভাল।
ভেরি গুড। আমি দেখতে যাব। আজই যাব; রিহার্সেলের পর চলে যাব। রাতে খাব তোমার সাথে।
জি আচ্ছা।
শোন আসিফ, টাকা পয়সা কিছু লাগবে?
এই মুহূর্তে না।
কোনোরকম সংকোচ করবে না। তোমার মত মানুষকে এটা জিজ্ঞেস করতে হচ্ছে—কি আফসোস বল তো।
আসিফ হেসে ফেলল।
হাসবে না, বুঝলে? এটা হাসির কোনো ব্যাপার না। এটা হচ্ছে একটা গ্রেট ট্র্যাজেডি। আসিফের তেমন কোথাও যাবার কথা ছিল না। বজলু সাহেবের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়াই তার প্রথম উদ্দেশ্য। বজলু কাউকে ধরলে সহজে ছাড়েন না। আসিফ এখন কি করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। বাসায় ফিরে যাওয়া যায়। খালি বাসায় ফিরে গিয়েই বা কী হবে? লীনা আছে স্কুলে। আজ আবার স্কুলে কিসের যেন পরীক্ষা। ছুটি হবে বিকেল পাঁচটায়। ছুটির জন্যে দরখাস্ত করেছিল–নামঞ্জর হয়েছে। স্কুলের চাকরিটা লীনার ছেড়েই দিতে হবে। ভয়ানক দিন সামনে। আসিফ হাঁটতে হাটতে ভাবছে। এইসব নিয়ে গুছিয়ে একটা নাটক লিখতে পারলে বেশ হত। তবে এই নাটক দর্শক নিত না। নাটকের বক্তব্য যাই হোক, তার মধ্যে বিনোদন থাকতে হবে। রিলিফ থাকতে হবে। ফিকাসোর যে ছবি, তারও বিনোদনের একটি দিক আছে।