তুমি যাচ্ছ তো।
না দুলাভাই। না কেন? তোমার বরকে ছেড়ে এই দশটা দিন তুমি থাকতে পারবে না?
তা না।
তাহলে অসুবিধাটা কোথায়।
অসুবিধা কিছু নেই।
জামান সাহেব নিজেই লীনাকে গাড়ি করে পৌঁছে দিলেন। কোমল গলায় বললেন, তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি যেতে চাচ্ছ না।
লীনা বলল, আপনি ঠিকই বুঝেছেন।
কর্তাকে ছাড়া যেতে মন চাচ্ছে না?
লীনা চুপ করে রইল। জামান সাহেব বললেন, লীনা তোমাকে আমি খোলাখুলি কিছু কথা বলি। কিছু কিছু কথা সরাসরি হওয়াই ভাল। দেখ লীনা, তোমাদের আর্থিক অবস্থার কথা আমি ভালভাবেই জানি। সেটা জেনে তোমার কর্তার জন্যে একটা টিকিট আমার কেন উচিত। কিনতেও আমার কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু মুশকিল কি জানো? তোমাদের আত্মসম্মান বোধ অনেক বেশি। তোমরা আহত বোধ করবে। ভাল করতে গিয়ে মন্দ করা হবে। আমি সত্যি চাই তুমি যাও আমাদের সঙ্গে। তোমার শরীর খারাপ। বেশ খারাপ। বাইরে একটু ঘুরে-টুরে এলে ভাল লাগবে।
লীনা কিছুই বলল না।
জামান সাহেব বললেন, আসিফকে নিয়ে গেলে আরেকটা বাস্তব সমস্যা আছে, সেটাও তোমাকে খোলাখুলি বলি। তোমার মা, আই মিন আমার শাশুড়ি আসিফকে তেমন পছন্দ করেন না। এগারো দিন এক সঙ্গে থাকতে হবে। এর মধ্যে তিনি অনেকবার আসিফকে নিয়ে অনেক অপ্রিয় প্রসঙ্গ তুলবেন। তোমার খুব খারাপ লাগবে।
লীনা বলল, আপনিইবা হঠাৎ দল বেঁধে বাইরে যাবার ব্যাপারে এত উৎসাহী হলেন কেন?
খুব ক্লান্ত লাগছে। টাকা বানানোর একটা মেশিন হয়ে পড়েছি। সারাদিন হাসপাতালে থাকি। বাসায় ফিরে বিশ্রামের বদলে রাত দশটা এগারোটা পর্যন্ত রুগী দেখি। জীবনটা মানুষের রোগশোকের মধ্যে আটকা পড়ে আছে। মুক্তি চাচ্ছি। কিছু সময়ের জন্যে হলেও মুক্তি। মাঝে মাঝে তোমাদেরকে আমার বেশ হিংসাই হয়। মনে হয় বেশ সুখেই তো তোমরা আছ।
আপনি কী অসুখে আছেন?
হ্যাঁ অসুখেই আছি। উত্তরায় বাড়ি করছি। কত রকম প্ল্যানিং কত পরিকল্পনা। ফলের গাছ কি কি থাকবে, ফুলের গাছ কি কি থাকবে। অথচ আমি নিজে ডাক্তার, আমি খুব ভাল করে জানি আমরা যে বেঁচে আছি। এইটাই পরম আশ্চর্যের ব্যাপার। দীর্ঘ পরিকল্পনা অর্থহীন।
ফিলাসফার হয়ে যাচ্ছেন দুলাভাই। এটা তো ভাল লক্ষণ না।
ফিলাসফার হতে পারলে তো কাজই হত। হাইলি মেটেরিয়েলিস্টিক মানুষ হয়ে জন্মেছি। এ ভাবেই মরব। আমার মত সাকসেসফুল ডাক্তারদের এটাই হচ্ছে ডেসটিনি।
অনেক রাতে আসিফের ঘুম ভেঙে গেল। ঘর অন্ধকার, বাইরে ঝুপ কুপ করে বৃষ্টি পড়েছে। খোলা জানালায় বৃষ্টির ছাট আসছে। হাওয়ায় মশারি উড়ে উড়ে যাচ্ছে। আসিফ বিছানায় উঠে বসল। লীনা
পাশে নেই এটা নতুন কিছু না প্রায় রাতেই ঘুম ভাঙলে লীনাকে পাশে দেখা যায় না। সে একাকী বারান্দার বেতের চেয়ারটায় বসে বাড়ির সামনের বাকড়া কাঁঠাল গাছের দিকে তাকিয়ে থাকে। আজও নিশ্চয়ই তাই আছে।
আসিফ বাতি জ্বালাল না। নিঃশব্দে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। লীনা তার দিকে তাকিয়ে হাসল। যেন সে জানত এই মুহুর্তে আসিফ এসে তার পাশে বসবে।
কি করছ লীলা?
কিছু না। বৃষ্টি দেখছি।
ঘুম আসছে না?
উঁহু।
ডাক্তার দেখাচ্ছ না কেন?
দেখাব। বস আমার পাশে। বৃষ্টি দেখতে দেখতে খানিকক্ষণ গল্প করি।
আসিফ বসতে বসতে মৃদু স্বরে বলল, একা একা বসে তুমি কি ভাব বল তো?
সাধারণত কিছু ভাবি না, আজ অবশ্যি ভাবছিলাম … কাশ্মির জায়গাটা দেখতে কেমন হবে। নিশ্চয়ই খুব সুন্দর, তাই না?
সুন্দর তো বটেই।
সব সুন্দর সুন্দর জায়গাগুলি ইন্ডিয়াতে পড়ে গেল। রাগ লাগে না তোমার?
লাগে।
কাশ্মির জায়গাটা কেমন হবে ভাবতে ভাবতে কি ঠিক করলাম জানো? ঠিক করলাম আমি দুলাভাইয়ের সঙ্গে ঘুরেই আসব।
খুব ভাল, যাও ঘুরে আসা। তোমার কাছে যাদি ভাল লাগে তাহলে পরে আমরা দু’জন আবার যাব। হাউস বোট ভাড়া করে থাকব।
কাশির দেখার জন্যে আমি যাচ্ছি না। কিন্তু আমি যাচ্ছি। অন্য কারণে।
অন্য কারণটা কি?
আমি আজমীর যাব। আজমীর শরীফে গিয়ে যা চাওয়া যায়। তাই নাকি পাওয়া যায়। আমি ঐ জন্যেই যাব। যেন আমাদের এই বারের বাচ্চাটা বেঁচে থাকে।
ওর বয়স কত হল লীনা?
তিন মাস। তুমি বিশ্বাস করবে না, আমি কিন্তু ওর হার্টবিট বুঝতে পারি।
সত্যি।
হ্যাঁ সত্যি। তবে সব সময় না। গভীর রাতে যখন একা একা বসে থাকি তখন।
এই জন্যেই কি তুমি রাত জাগ?
হুঁ।
আসিফ সিগারেট ধরাল। তার পাশে বসে থাকা এই মেয়েটি তার কত দিনের চেনা, অথচ গভীর রাতে সে যখন একা একা বসে থাকে তখন কেমন অচেনা হয়ে যায়।
লীনা বলল, অনেক’দিন তোমাদের রিহার্সেলে যাই না। রিহার্সেল কেমন হচ্ছে?
বেশি ভাল হচ্ছে না। শো পিছিয়ে দিয়েছে, সব কেমন ঢ়িলা ঢালা হয়ে গেছে।
পুষ্প মেয়েটা কেমন করছে?
ভাল করছে।
আমার চেয়েও ভাল?
হ্যাঁ, তোমার চেয়েও ভাল।
আমাকে যেমন অভিনয়ের আগে একটা বক্তৃতা দিয়েছিলে, ওকেও কি দিয়েছিলে?
হুঁ।
আচ্ছা ষষ্ঠ দৃশ্যে তুমি যখন পুষ্পকে জড়িয়ে ধর, তখন তোমার কেমন লাগে?
আসিফ অবাক হয়ে বলল, এই প্রশ্ন করছ কেন?
এমনি করছি, কিছু মনে করো না।
বৃষ্টির বেগ আরো বাড়ছে। ঝড়ের মত হচ্ছে।
জামগাছের পাতায় শো শো শব্দ। ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়েছে। সমস্ত শহর অন্ধকারে ডুবে গেছে। আসিফ বলল, চল শুয়ে পড়ি। লীনা বিনাবাক্যব্যয়ে উঠে এল। দুজনের কেউই বাকি রাত মুক্ত পুরুদা। আসিফ জেগে জেগে ওনাল বৃষ্টির শব্দ, লীনা শুনতে চেষ্টা করল অনাগত শিশুটির হৃৎপিণ্ডের শব্দ।
মতিঝিলের ট্রাভেল এজেন্সি
হাঞ্চ ব্যাক অব মীরপুর পিঠ সোজা করে মতিঝিলের ট্রাভেল এজেন্সি সুরমা ট্রাভেলস-এ ঢুকলেন। তাঁর সঙ্গে আসিফ। বিশাল অফিস। দু’জন স্টেনো বা রিসিপশনিস্ট ধরনের মেয়ে বসা। একজনের দিকে তাকানো যায় না। মৈনাক পর্বত। তবে অন্য জন রূপবতী। মৈনাক পর্বত মধুর গলায় বলল, আপনাদের জন্যে কি করতে পারি?