বসির মিয়া বদলাতে চায় না। তিনি বড়ই বিরক্ত হন।
আহা বদলাতে বললাম না? ইটের কি অভাব হয়েছে যে একটা ক্রিপলড ইট দিতে হবে। চেঞ্জ ইট।
রিটায়ার করার পরও হয়ত ওয়াদুদুর রহমান সাহেবের কুড়ি বছরের মতো আয়ু ছিল, সেই আয়ু বাড়ি তৈরি করতে গিয়ে তিনি খরচ করে ফেললেন। ছাদ ঢালাইয়ের পর দিন স্ট্রোকে মারা গেলেন।
কারো জন্যেই কিছু থেমে থাকে না। যথাসময় বাড়ি শেষ হল। দোতলা করা গেল না। একতলা বানাতেই সঞ্চিত প্রতিটি পয়সা শেষ হয়ে গেল। লীনার মা সুলতানা বেগম একতলা বাড়ির দুটো ঘর নিয়ে থাকেন। বাকিটা ভাড়া দিয়েছেন, তার ডাক্তার জামাইকে। এই ডাক্তার জামাই বাড়িটাকে মোটামুটি একটা হাসপাতাল বানিয়ে ফেলেছে। রোজ বিকাল চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত এখানে রুগী দেখা হয়। ভদ্রলোকের ভাল পসার হয়েছে। রুগীতে সারাক্ষণ বাড়ি ভর্তি থাকে। সুলতানার গা শিরশির করে, কিন্তু জামাইকে কিছু বলতে পারেন না।
আজ শুক্রবার। ডা. জামান শুক্রবারে রুগী দেখেন না, তবু দু-তিন জন রুগী বাইরের বারান্দায় বসে আছে। ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে দেখা না করে তারা কিছুতেই যাবে না। লীনাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে তাকেই ধরল, আপা ডাক্তার সাহেবকে একটু বলে দেন। খুব বিপদে পড়েছি।
লীনা মার শোবার ঘরে ঢুকতেই একসঙ্গে সবাই হৈচৈ করে উঠল। লীনার বড় বোন দীনা বলল, ঝড় বৃষ্টির মধ্যে রিকশা নিয়ে চলে এলি? তোকে আনতে গাড়ি গেছে। সবচে ছোট বোন নীনা বলল, একটা লেটেস্ট মডেল গাড়িতে চড়া মিস করলে আপা। দুলাভাই নতুন গাড়ি কিনেছে। বড় আপাদের এখন দুটো গাড়ি। সুলতানা বললেন, জামাইকে আনলি না কেন? আমরা নাটক করি না বলে বুঝি আমাদের বাড়িতে আসা যাবে না।
নাটকের একটা খোঁচা না দিয়ে সুলতানা মেজো জামাই সম্পর্কে কিছু বলতে পারেন না। আজও পারলেন না। লীনার মনটা খারাপ হয়ে গেলেও সহজ স্বরে বলল, ওর কাজ আছে মা, রাত দশটার আগে ছাড়া পাবে না।
সুলতানা তিক্ত গলায় বললেন, আমার তিন জামাইয়ের মধ্যে মেজোটাই সবচে কাজের হয়েছে। রাত দশটা-এগারোটার আগে কোনোদিন ছাড়া পায় না।
লীনা বলল, জামাই প্রসঙ্গ থাক মা! সবাই তো আর এক রকম হয় না। কেউ কাজের হয়, কেউ হয় অকাজের কি আর করা। কি জন্যে ডেকেছ বল? কারো জন্মদিন-টিন নাকি? আমি তো কিছু মনে করতে পালাম না। ফুল নিয়ে এসেছি। যার জন্মদিন সে নিয়ে নিক।
নীনা ছুটে এসে ফুল নিয়ে নিল। নীনার কাছ থেকে ফুল নেবার জন্যে বড় জামাই ঝাপিয়ে পড়ল। নীনা তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, প্লিজ আমার ফুলগুলি সেভ কর। বলেই সে ফুলের তোড়া ক্রিকেট বলের মত ছুড়ে মারল স্বামীর দিকে। সুলতানা কপট বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে বললেন, এরা সব সময় কি যে যন্ত্রণা করে। এই তোরা চা খাবি না কফি খাবি? যেটাই খাবি একটা। দু-তিন পদের জিনিস বানাতে পারব না।
দীনা ও দীনার স্বামী জামান সাহেব বললেন, কফি।
নীনা বলল, চা।
নীনার স্বামী লুৎফুল হক চেঁচিয়ে বলল, সরবত।
চারদিকে তুমুল হাসি শুরু হল। লীনা মনে মনে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। এই সব চমৎকার হাসিখুশির মুহূর্তগুলিতে আসিফ কখনো অংশ নিতে পারে না। মাঝে মাঝে সে যে উপস্থিত থাকে না তা নয়। থাকে, কিন্তু বড়োই বিব্রত বোধ করে। দেখে মনে হয় তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। সবাইকে একত্র করার উদ্দেশ্য ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। জামান সাহেব বললেন, রাতে খাওয়াদাওয়ার পর অফিসিয়ালি সেটা বলা হবে। টপ সিক্রেট। এখন আমি আমার নতুন গাড়িতে সবাইকে নিয়ে একটা চক্কর দেব। এখান থেকে সাভার যাব সাভার থেকে ফিরে আসব। টাটকা হাওয়ায় খিদেটা জাগবে। আমাকে বিশ মিনিটের জনো ক্ষমা করতে হবে। আমার কয়েকটা রুগী বসে আছে। বিদেয় করে আসি।
লুৎফুল বলল, ছুটির দিনেও রুগী দেখোন! এত টাকা দিয়ে করবেন কি দুলাভাই? লোকজন ব্লাড প্রেসারে মারা যায়… আপনি দেখি টাকার প্রেসারে মারা যাবেন।
জামান সাহেব ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলেন। সুখী মানুষের হাসি। সুখী মানুষ অতি তুচ্ছ রসি চতায় হেসে ভেঙে পড়তে পারে।
নিমন্ত্রণের রহস্য জানা গেল রাতের খাবারের পর। জামান সাহেব ছোটখাটো একটা বক্তৃতা দিলেন। তিনি সবাইকে নিয়ে কাশ্মির যেতে চান। শুধু কাশ্মির না আগ্রা। জয়পুর এবং কাশ্মির। থাকা খাওয়ার যাবতীয় খরচ তার। দুই শ্যালিকা এবং শাশুড়ির টিকিটও উনি কাটবেন। অন্য কেউ যেতে চাইলে তাদের টিকিট তাদের কাটতে হবে। এই ভ্রমণে বাচারা কেউ যাবে না।
লুৎফুল বলল, আমার টিকিট কাটবেন না, এর মানেটা কি দুলাভাই?
আমার কর্তব্য হচ্ছে শ্যালিকা পর্যন্ত, এর বাইরে না।
নীনা বলল, আপনি কি সত্যি মিন করছেন দুলাভাই?
তোমার সন্দেহ আছে নাকি?
হ্যাঁ আছে। আপনার মধ্যে যে একজন হাতেমতাই লুকিয়ে আছে সেটা জানা ছিল না।
এখন জানলে?
তা জানলাম। যাচ্ছি কবে আমরা?
সামনের মাসের এগারো তারিখে, ফিরব বাইশ তারিখ। দীনা, তুমি ওদের টিকিট ওদের দিয়ে দাও।
নীলা বিস্মিত হয়ে বলল, টিকিটও কেটে ফেলেছেন!
অফকোর্স। আমি কাঁচা কাজ করি না। ঢাকা-দিল্লি-ঢাকা রিটার্ন টিকিট।
লীনা কিছুই বলল না। চুপচাপ বসে রইল। জামান সাহেব বললেন, আমার মেজো শালীকে দেখে মনে হচ্ছে তার ফাঁসির হুঁকুম হয়েছে। লীনা তুমি এমন মুখ কালো করে বসে আছ কেন?
আমার শরীরটা ভাল না দুলাভাই।