আসিফ মঞ্চে এসে দাঁড়াল। সহজ স্বরে বলল, এস শুরু করা যাক। বলেই সে বদলে গেল। পুষ্প মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখল। এই লোকটা নিমিষের মধ্যে কি করে যেন বদলে গিয়ে লেখক হয়ে গেল। লেখক এবং তার স্বামী। খুবই নিকটের কেউ।
লেখক : অসাধারণ একটা আইডিয়া মাথায় এসেছে জরী। অসাধারণ উপন্যাসের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় এটা শুরু হবে। একটা শহর। মনে করা যাক এই ঢাকা শহর। এর উপর ঝড় আসছে, প্লাবন আসছে, মহামারী আসছে। শুধু মৃত্যু আর মৃত্যু। কেমন হবে বল তো?
জরী : খুব ভাল হবে।
লেখক : একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রথমে ঝড়, তারপর বন্যা, তারপর…
জরী : একটা ভূমিকম্প দিয়ে দাও।
লেখক : রাইট, ভূমিকম্প। ভূমিকম্পের কথাটা ভুলেই গিয়েছিলাম।
জরী : বিরাট একটা ভূমিকম্প হোক। সেই ভূমিকম্পে পুরো ঢাকা শহর তলিয়ে যাক।
লেখক : ঠাট্টা করছ? জরী : না, ঠাট্টা করছি না। এক’দিন দেখা যাবে যেখানে ঢাকা শহর ছিল, সেখানে বিরাট একটা হ্রদ।
লেখক : কি বলছ তুমি!
জরী : আমরা সেই হ্রদের পাশে ছোট্ট একটা কঁড়ে ঘর বানাব। আমাদের একটা নৌকা থাকবে। নৌকায় করে আমরা হিদের ঘুরব।
[লেখক প্রচণ্ড রাগে স্ত্রীর গালে চড় বসিয়ে দিলেন। পরমুহুর্তেই স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বলছেন।] লেখক : প্লিজ, জারী প্লিজ। আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি ভুল করে ফেলেছি।
অভিনয় শেষ হয়েছে। আসিফ এখনো পুষ্পকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। হাতের বাঁধন এতটুকুও আলগা না করে সে বলল, মজনু গ্লাসে করে পানি আন তো, মেয়েটা ফেইন্ট হয়ে গেছে।
আসিফ খুব সাবধানে পুষ্পকে টেবিলে শুইয়ে দিয়ে সহজ গলায় বলল, বজলু ভাই, খুব বড় মাপের একজন অভিনেত্রী পেয়ে গেলেন। আপনার উচিত আমাকে মিষ্টি খাওয়ানো।
বজলু ভাই মানিব্যাগ বের করে সত্যি সত্যি একশ টাকার একটা নোট বের করলেন মিষ্টির জন্যে।
পুষ্প টেবিলে উঠে বসে ঘোর লাগা চোখে চারদিকে তাকাচ্ছে। আসিফের দিকে চোখ পড়তেই আসিফ বলল, তুমি যে কত ভাল করেছ তুমি নিজেও জান না।
পুষ্প কিছু বুঝতে পারছে না। সব কিছু তার কেমন জানি এলোমেলো হয়ে গেছে। এই জায়গাটা কি? তাদের বাসা? নাকি অন্য কোনো জায়গা?
হাশমত আলি বিকেলে বাজার করে ফিরেছে
হাশমত আলি বিকেলে বাজার করে ফিরেছে। সস্তায় পেয়েছে দুটো বিশাল সাইজের ইলিশ। বৈশাখ মাসের শুরু। ইলিশ মাছে স্বাদ এসে গেছে। এই সময়ে এত সস্তায় ইলিশ পাওয়ার কথা না। ভাগ্যক্রমে পাওয়া গেছে।
বারান্দায় মাছ কাটা হচ্ছে। বটিটা বেশ ধারালো কচ কিচ করে কেটে যাচ্ছে। দেখতে ভাল লাগছে। খুকিকে কোলে নিয়ে হাশমত আলি মুগ্ধ চোখে মাছ কোটা দেখছে। তার জীবনের এটা একটা আনন্দঘন মুহূর্ত।
লীনা চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। হাশমত বলল, ভাবী মাছ দেখলেন? পেটটা কেমন গোল। এর স্বাদই অন্য রকম। রাতে আমাদের সঙ্গে খাবেন ভাবী, মনে থাকে যেন।
লীনা বলল, আমি তো খেতে পারব না। আপনার ভাইকে খাইয়ে দেবেন। আমি একটু মার বাসায় যাচ্ছি।
তাহলে এমনি এমনি এক টুকরা মাছ খান। বেনু ভেজে দেবে।
না ভাই থাক।
এক মিনিট লাগবে। ইলিশ মাছ ভাজা হতে এক মিনিটের বেশি লাগে না।
আমার ইচ্ছা করছে না। শরীরটা ভাল না। ফ্রিজে থাকুক। একসময় খাব।
ফ্রেস জিনিস তো আর পাচ্ছেন না ভাবী।
ফ্রেস জিনিস তো সব সময়ই আপনার কাছ থেকে পাচ্ছি, তাই না হাশমত সাহেব?
জি ভাবী।
আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল। আপনি কী একটু বসার ঘরে আসবেন। বেনুর সামনে বলতে কেমন জানি সংকোচ বোধ করছি।
বেনু বিস্মিত হয়ে তাকাল। হাশমত আলি নিঃশব্দে উঠে এল বসার ঘরে। অবাক হয়ে বলল, কি ব্যাপার ভাবী?
এ মাসের বাড়ি ভাড়াটা কী আপনি দিয়ে দেবেন? একটু সমস্যা হচ্ছে। আমি দিন দশেকের মধ্যে–
এটা কোনো ব্যাপারই না ভাবী। এটা নিয়ে আপনি চিন্তাই করবেন না। এই মাস কেন? দরকার হলে ছমাসের ভাড়া দিয়ে রাখব। আপনি আমাকে ভাবেন কী?
লীনা খুব কৃতজ্ঞ বোধ করছে। হাশমত আলিকে এই কথাটা কি করে বলবে এটা ভাবতে তার মাথা ধরে গিয়েছিল। এখন মাথা ধরাটা নিমিষের মধ্যে চলে গেছে।
হাশমত আলি বলল, কথাটা বেনুর সামনে না বলে ভাল করছেন। টাকা-পয়সার কোনো কথায় মেয়েছেলে থাকা উচিত না।
লীনা হেসে বলল, আমি নিজেও তো মেয়েছেলে।
কি যে বলেন ভাবী, কোথায় আপনি আর কোথায় বেনু। আকাশ আর পাতাল ফারাক।
লীনা বলল, আপনার ভাই এলে বলবেন আমি মার কাছে গিয়েছি। রাতই ফিরব। সে যেন খেয়ে নেয়।
জি আচ্ছা বলব। আপনি একটা ছাতা নিয়ে যান ভাবী! দিনের অবস্থা ভাল না। ঝড়-বৃষ্টি হতে পারে।
ছাতা লাগবে না।
লাগবে না বলছেন কি? অবশ্যই লাগবে। লেডিস ছাতা ঘরে আছে। ব্রান্ড নিউ। জাপানি।
হাশমত নিজেই লেডিস ছাতা বের করে আনল।
লীনার বাবা ওয়াদুদুর রহমান সাহেব চাকরি থেকে রিটায়ার করার পর বাড়ি তৈরিতে হাত দিয়েছিলেন। ঝিকাতলায় তার জমি কেনা ছিল। রিটায়ার করবার সঙ্গে সঙ্গে যুবকের উৎসাহে ঝাপিয়ে পড়লেন। তার সাৰ্ব্বক্ষণিক ধ্যান জ্ঞান হচ্ছে বাড়ি। চমৎকার দখিনদুয়ারি বাড়ি। ইস্টার্ন রীতি অনুযায়ী বিরাট বারান্দা থাকবে, আবার ওয়েস্টার্ন ধরনে প্রতিটি ঘরে থাকবে বিল্ট ইন কাবার্ড। লোকজন বাথরুম বানানোয় কিপটেমী করে, তিনি করবেন না। বাথরুমে ঢুকেই যেন খোলামেলা ভাব হয়। প্রতিটি বাথরুমে থাকবে ঝকঝকে বাথটাব। দরজা-জানালা হবে সিজন করা বাৰ্মা টিকের। আজকাল কি সব কাঠ দিয়ে দরজা-জানালা করে, গরম কালে ক্যাচর্ক্যাচ শব্দ হয়। ওয়াদুদুর রহমান সাহেব প্রতিটি জিনিস নিজে পছন্দ করে কিনলেন। মিস্তিরিরা সিমেন্ট বালি মিশিয়ে মশলা তৈরি করে, তিনি পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। ইট বিছিয়ে দেয়াল তৈরি হয় তিনি আগ্রহে দেখেন, মাঝে মাঝে দিৰ্দেশ দেন ঐ ইটটা বদলে দাও বসির মিয়া। ইটটা বঁকা।