তোমাকে সত্যি কথা বলি আসিফ, নাটককটা আমার কাছে বেশি সুবিধার মনে হচ্ছে না। কোনো কনফ্রিকট নেই। রিলিফ নেই। ক্লাইমেক্স নেই।
জিনিস কিন্তু ভাল।
ভালর তুমি কি দেখলে?
প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত স্বপ্ন স্বপ্ন ব্যাপার আছে। কঠিন কিছু কথা খুব নরম করে বলা।
নরম করে বললে এই দেশে কিছু হয় না। শক্ত করে বলতে হয়। পাছায় লাথি দিতে হয়।
সবাই তো পাছায় লাথি দেয়া নাটক নিয়ে যাবে। আমরা না হয় একটা নরম নাটক নিয়ে যাই। নরম হলেও এটা খুব নামকরা নাটক বজলু ভাই। কবি এমিলি জোহানের কাব্যনাটক। বাংলায় ভাবানুবাদ করা। সত্যি করে বলুন তো আপনার ভাল লাগে না?
আর আমার ভাল লাগা। তোমাকে আরেকটা সত্যি কথা বলি আসিফ, আজ পর্যন্ত কাউৰে বলিনি। তোমাকে বলছি নাটক ভাল না মন্দ এটা আমি বুঝি না। আমি শুধু বুঝি–অভিনয় ঠিকমত হচ্ছে কি না।
আপনি সবই বোঝেন। শুধু বোঝেন বললে কম বলা হবে, খুব ভালই বোঝেন। দেখুন বজলু ভাই, আমি মানুষটা খুব অহংকারী, আমি অভিনয় ভাল করি। নিজে সেটা জানি–অভিনয়ের ব্যাপারে। আমি কারোর কোনো উপদেশ শুনি না, কিন্তু আপনার কথা আমি শুনি। বজলু ভাই, দেরি হয়ে যাচ্ছে, আপনি চলে যান।
রিহার্সেল শুরু হতে খানিকটা দেরি হল। প্রণব বাবুর বড় মেয়ে বৃত্তি পেয়েছে সেই উপলক্ষে তিনি প্রচুর খাবার দাবার এনেছেন। হৈ হৈ করে খাওয়াদাওয়া হচ্ছে। গ্রুপের মেয়েরা কেউ নেই সবাই বজলু সাহেবের সঙ্গে পুষ্প মেয়েটির কাছে গেছে। এই সুযোগে জলিল সাহেব আদিরসের দুটো গল্প বলে ফেললেন। দুটোর মধ্যে একটা হিট করল। কারোর হাসি আর থামতেই চাচ্ছে না। এই দলটিকে দেখলে কে বলবে এদের জীবনে কোনো দুঃখ কষ্ট আছে? এদের দেখে মনে হচ্ছে গভীর আনন্দে এদের হৃদয় পরিপূর্ণ। রিহার্সেলের ঘরে এরা যখন ঢোকে জীবনের সমস্ত হতাশা ও বঞ্চনা পেছনে ফেলে ঢোকে। নাটক তাদের দ্বিতীয় জীবন। এই জীবনটাই তারা আঁকড়ে ধরে। দ্বিতীয় জীবনই এক এক সময় প্রধান হয়ে দাঁড়ায়।
তৃতীয় দৃশ্য শুরু হল। এটিও রাতের দৃশ্য। লেখক শোবার ঘরে। বিছানায় বসে আছেন। পাশেই তাঁর স্ত্রী কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। লেখক লিখে যাচ্ছেন। হঠাৎ একটা শব্দ হল। লেখক চমকে তাকালেন ঘরের মধ্যে কে যেন দাঁড়িয়ে। যে দাঁড়িয়ে, তার চোহোরা ভাল না। সে কঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখের দৃষ্টি নিম্প্রভ। তার নাম ছলিমুদ্দিন। ছলিমুদিনের ভূমিকায় অভিনয় করছেন প্রণব বাবু।
লেখক অবাক হয়ে ছলিমুদ্দিনকে দেখছেন। চিনতে পারছেন না। এই গভীর রাতে শোবার ঘরে লোকটা কোথেকে এল বুঝতে পারছেন না। তিনি খানিকটা ভীত।
লেখক : কে কে কে?
ছলিমুদিন : আস্তে। চেঁচাবেন না। আপনার স্ত্রী জেগে উঠতে পারেন।
লেখক : কে কে? আপনি কে?
ছলিমুদিন : চিনতে পারছেন না? কি অদ্ভুত কথা। নিজের সৃষ্টি করা চরিত্র নিজেই চিনতে পারছেন না। ভাল করে তাকিয়ে দেখুন, জীবন যুদ্ধে পরাজিত, ক্লান্ত শ্ৰান্ত একজন মানুষ, আজ সারাদিন যার খাওয়া হয়নি। যার প্রেমিকা অন্য এক পুরুষের হাত ধরে…
লেখক : ও আচ্ছা, আপনি ছলিমুদ্দিন।
ছলিমুদিন : হ্যাঁ ছলিমুদ্দিন। আপনি আমার জন্যে একটা ভাল নাম পর্যন্ত খুঁজে পাননি। নাম দিয়েছেন ছলিমুদ্দিন। সুন্দর, শোভন, আনন্দদায়ক কিছুই আপনি আমার জন্যে রাখেননি। একটি ভাল নাম কি আমার হতে পারত না?
লেখক : না, পারত না। আপনার জন্ম হয়েছে কৃষক পরিবারে। আপনার বাবা একজন বর্গাদার। সে তার পুত্রদের এ রকম নামই রাখবে। একজন কৃষক তার পুত্রের নাম নিশ্চয়ই আবরার চৌধুরী রাখবে না।
ছলিমুদিন : আপনি ইচ্ছা করলে সবই সম্ভব। কলম আপনার হাতে। আপনি ইচ্ছা করলেই কোর্টে এফিডেভিট করে আমি আমার নাম পাল্টে আবরার চৌধুরী করতে পারি। আপনি ইচ্ছা! করলেই বিদেশী কোনো কোম্পানিতে আমার চমৎকার একটা চাকরি হতে পারে। ছলিমুদ্দিন নামটা যদি আপনার এতই প্রিয় হয়, বেশ তো আপনার ড্রাইভারের ঐ নাম দিয়ে দিন।
লেখক : তা সম্ভব নয়।
ছলিমুদ্দিন; কেন সম্ভব নয়? একের পর এক আপনার কারণে আমি জীবন যুদ্ধে পরাজিত হচ্ছি। কেন আপনি এ রকম করছেন?
লেখক : এ রকম করছি কারণ, তোমার মাধ্যমে আমি সমাজকে তুলে আনছি। তুমি আলাদা কেউ নও। তুমি এই সমাজেরই একজন প্রতিনিধি। তোমাকে দেখে পাঠক চমকে উঠবে। ঘা খাবে।
ছলিমুদিন : আপনি আমাকে তুমি করে বলছেন কেন? নিজের লেখা পড়ে দেখুন, বয়সে আমি আপনার চেয়ে বড়। এ জীবনে তো আপনি আমাকে কিছুই দেননি। সামান্য সম্মানটুকু অন্তত দিন।
লেখক : আমার ভুল হয়েছে। ক্ষমা করবেন। এখন থেকে আপনি করে বলব।
ছলিমুদিন : ধন্যবাদ, আপনাকে যতটা হৃদয়হীন মনে করেছিলাম তত হৃদয়হীন আপনি নন। এটাই যখন করলেন তখন আরেকটু করুন। আমার প্রেমিকাকে আপনি ফিরিয়ে দিন। অর্থ বিত্ত, কিছুই চাই না। আমি পথে পথে না খেয়ে ঘুরতে রাজি আছি। আপনি শুধু আমার প্রেমিকাকে ফেরত দিন।
লেখক : তা হয় না।
ছলিমুদিন : অবশ্যই হয়। আপনি নিজে তো আপনার স্ত্রীকে পাশে নিয়ে আরাম করে বসে আছেন। আমি কেন বসব না? সমাজ দোষ করতে পারে, রাষ্ট্র দোষ করতে পারে–আমি তো কোনো দোষ করিনি। আমি কেন শাস্তি পাব?
লেখক : এই পচা সমাজে নির্দোষ যারা, তারাই শাস্তি পায়।
ছলিমুদিন : সমাজ করুক। আপনি কেন করবেন? আপনি মানবপ্রেমিক একজন লেখক। আপনি আমার প্রতি করুণা করুন। আপনি শেষের কুড়িটা পাতা ছিঁড়ে ফেলুন। আবার নতুন করে লিখুন। এর মধ্যে আমি আপনার জন্যে চা বানিয়ে নিয়ে আসছি।