কষ্ট লাগার কি আছে?
কষ্ট লাগার কিছু নেই? কি বলছিস তুই! একটা বাড়িতে থাকিস, সেই বাড়ির রান্নাঘর অন্য একজনের সঙ্গে শেয়ার করতে হয়। এটা কেমন কথা?
সবার তো সব কিছু হয় না।
চেষ্টা করলে ঠিকই হয়। চেষ্টা না করলে হবে কিভাবে? কোনো রকম চেষ্টা নাই, বড় হবার ইচ্ছা নাই—নাটক, নাটক, নাটক।
এই সব বাদ দাও আপা, দেখি চা পাওয়া যায়। কিনা। মাথা ভার ভার লাগছে। চা খেলে ভাল লাগবে।
রাত দুপুরে চা পাবি কোথায়? চুপ করে বোস। তোর সঙ্গে দেখাই হয় না। সুযোগ পাওয়া গেল।
আসিফ সিগারেট ধরাল। তার সত্যি সত্যি ঘুম পাচ্ছে। সিগারেটের ধোঁয়া দিয়েও ঘুম তাড়ানো যাচ্ছে না। রাত জাগার জন্যই বোধ হয় প্রচণ্ড খিদেও লাগছে। খালি পেটে সিগারেট–নাভিতে পাক দিচ্ছে। মনে হচ্ছে বমি হয়ে যাবে।
আসিফ।
বল আপা।
তুই আমাকে একটা সত্যি কথা বল তো।
বেশির ভাগ সময়ই আমি সত্যি কথা বলি।
তোর কি এখন চাকরি নেই?
এই কথা বলছি কেন?
তুই তোর দুলাভাইকে বলেছিস তোর জন্যে একটা কিছু দেখে দিতে। এই থেকে অনুমান করছি। তোর কি চাকরি নেই?
না নেই।
ক’দিন ধরে নেই?
মাস দুই।
তোর বউ জানে?
জানবে না কেন? জানে।
তবু তুই নাটক কারবি? এর পরেও তোর শিক্ষা হয় না? তুই কি মানুষ না জানোয়ার?
রেহানা উঠে চলে গেলেন। আসিফ একা একা বসে রইল।
বেশিক্ষণ একা বসে থাকতে হল না। রেহানা আবার এসে ঢুকলেন। তিনি খুব কঠিন কিছু কথা বলতে এসেছিলেন… বলতে পারলেন না। আসিফের বসে থাকার ভঙ্গিটি দেখে তার খুব মায়া লাগল।
লিটল ফ্লাওয়ার্স, ইংরেজি স্কুল
লীনা যে স্কুলে পড়ায় তার নাম–লিটল ফ্লাওয়ার্স। ইংরেজি স্কুল। খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি। নানান কায়দা কানুন। সপ্তাহে সপ্তাহে পরীক্ষা। মাসে একবার আউটিং।
আজ সেই আউটিংয়ের দিন। লীনাকে ক্লাস ওয়ানের ছেলেমেয়েদের নিয়ে যেতে হবে সাভার স্মৃতিসৌধে। একটা মাইক্রোবাস জোগাড় করা হয়েছে। লীনার সঙ্গে যাচ্ছে অতসী দি। গেম টিচার। মাইক্রোবাসে ওঠবার ঠিক আগ মুহূর্তে লীনা অতসীকে বলল, আমার না শরীরটা খুব খারাপ লাগছে অতসী দি।
অতসী বলল, যেতে চাও না?
না। শরীরটা খুবই খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে ফেইন্ট হয়ে যাব।
অতসী বলল, তুমি কি কনসিভ করেছ নাকি?
লীনা জবাব দিল না। এসব নিয়ে কথা বলতে ভাল লাগে না। অথচ বিবাহিত মেয়েরা কত স্বাভাবিক ভাবেই না। এসব নিয়ে আলাপ করে। লীনার মাঝে মাঝে মনে হয়–তার মধ্যে কিছুটা অস্বাভাবিকা আছে।
তুমি এখন না গেলে বড়। আপা খুব রাগ করবেন।
শরীরটা খুব খারাপ লাগছে অতসী দি।
তোমাকে দেখেই বুঝতে পারছি। দাঁড়াও, আপার সঙ্গে আলাপ করে আসি। লীনা ছায়ায দাঁড়িয়ে রইল। বাচ্চাগুলি মাইক্রোবাসে উঠে বসে আছে। কোনো সাড়াশব্দ করছে না, যেন একদল রোবট। ট্রেনিং দিয়ে দিয়ে এদের রোবট বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। হুঁকুম ছাড়া এরা মুখ খুলবে না। এর কোনো মানে হয়। শিশুরা থাকবে শিশুদের মত। হৈচৈ করবে, মারামারি করবে, কাদবে, হাসবে। অতসী ফিরে এসে বলল, ব্যাপার সুবিধার না লীনা। বড় আপা খুব রেগে গেছে। তুমি যাও শুনে আস।
প্রিন্সিপ্যাল জোবেদা আমিন সত্যি সত্যি রেগেছেন। লীনাকে ঢুকতে দেখে তিনি শুকনো গলায় বললেন, বোস। বলেই টেলিফোন নিয়ে বাস্ত হয়ে পড়লেন।
হ্যালো, প্রিন্সিপ্যাল জোবেদা আমিন বলছি…
এইসব কেজি স্কুলগুলির প্রধানরা বিচিত্র কারণে প্রিন্সিপ্যাল পদবি নেন। কেজি স্কুলগুলিতে কোনো হেড মিসট্রেস নেই। সব প্রিন্সিপ্যাল। এরা কথাবার্তায় সত্ত্বর ভাগ ইংরেজি বলেন। অদ্ভুত ধরনের ইংরেজি।
লীনা।
জি আপা।
আপনি এসব কি শুরু করেছেন বলুন তো?
তেমন কিছু তো শুরু করিনি। আপা। শরীরটা ভাল না, এটাই বলছি।
একটা এ্যারেঞ্জমেন্ট সম্পূর্ণ হবার পর আপনারা বলবেন শরীর খারাপ, তাহলে কি করে হবে বলুন? আৰু এই শরীর খারাপ ব্যাপারটাও তো নতুন না। দু’দিন পর পর শুনছি শরীর খারাপ। এ ভাবে তো আপনি মাস্টারি করতে পারবেন না। আপনি বরং অন্য কোনো প্রফেসন খুঁজে বের করুন যেখানে তেমন কাজকর্ম নেই।
লীলা উঠে দাঁড়াল।
জোবেদা আমিন ঝাঁঝালো গলায় বললেন, যাচ্ছেন কোথায?
বাসায় জলে যাব। শরীরটা ভাল লাগছে না।
জোবেদা আমিন কঠিন চোখে তাকিয়ে আছেন। লীনার খুব ইচ্ছা করছে বলে, আপনি কি আপা কখনো লক্ষ্য করেছেন যে আপনার গোঁফ আছে? গায়ের রঙ কালো বলে তেমন বোঝা যাচ্ছে না। ফর্সা হলে রোজ-শেভ করতে হত।
কথাটা বলা হল না। লীনা বাসায় চলে এল। বাসায় এসেই শারীর খারাপ ভাবটা কেন জানি কেটে গেল। সে রেণুর সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্প করল। খুকিকে গামলায় পানি নিয়ে গোসল করিয়ে দিল।
দুপুরে দরজা জানালা বন্ধ করে খানিকক্ষণ ঘুমুল। ঘুম ভাঙার পর মনে হল আসিফ থাকলে বেশ হত। দু’জন বিকেলে কোথাও বেড়াতে যাওয়া যেত। মীরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন কিংবা বলধা গার্ডেন।
আসিফকে আজকাল কাছেই পাওয়া যায় না। বেচার চাকরির জন্যে ব্যস্ত হয়ে সারাদিন ঘোরে। কোথায় কোথায় ঘোরে, কার কাছে যায় কে জানে!
আজ অবশ্যি আসিফ চাকরির সন্ধ্যানে ঘুরছিল না। সে চুপচাপ টেলিভিশন রিহার্সেল রুমে বসেছিল। শেষ পর্যন্ত ঋণপ্রার্থী লোকটির ক্ষুদ্র ভূমিকা নিতে সে রাজি হয়েছে। কৌতূহল থেকেই রাজি হয়েছে। দেখাই যাক না টিভি অভিনয় ব্যাপারটা কি? টেলিভিশন এখন অতি শক্তিশালী একটি মাধ্যম। একে উপেক্ষা করার প্রশ্নই ওঠে না।