জি আচ্ছা, আমি যাব।
ভেরি গুড। ইয়াং ম্যান, পরে এক’দিন দেখা হবে, কেমন?
আসিফ জবাব দেবার আগেই লীনা বলল, আপনি আজই চলুন না। আমাদের সঙ্গে গাড়ি আছে। আপনাকে বাসায় পৌঁছে দেবে। প্লিজ।
ওয়াদুদুর রহমান সাহেব শীতল গলায় বললেন, বেচারা অভিনয় করে ক্লান্ত হয়ে আছে। আজ থাক। কোনো একটা ছুটির দিনে বরং…।
না বাবা আজ। ভাল লাগাটা থাকতে থাকতে ওকে বাসায় নিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে। আপনার কি খুব অসুবিধা হবে? প্লিজ আসুন না, প্লিজ।
আসিফ গেল। ওয়াদুদুর রহমান সাহেবের পরিবারের অন্য সবার সঙ্গে এক টেবিলে বসে ভাত খেল।
ওয়াদুদুর রহমান সাহেবের স্ত্রী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলেন–বাবা কি করেন? ভাই-বোন ক জন? বোনদের কোথায় বিয়ে হয়েছে? সে কি পড়ছে? ম্যাট্রিক রেজাল্ট কি?
আই. এ. তে কি রেজাল্ট?
লীনা এক সময় বিরক্ত হয়ে বলল, চুপ কর তো মা! কি শুধু উকিলের মত প্রশ্ন করছি। ওকে ভাত খেতে দাও।
মা চুপ করলেন না। প্রশ্ন করা ছাড়াও তাঁর পরিবারের সমস্ত তথ্য দিয়ে দিলেন। তার তিন মেয়ে এক ছেলে। ছেলে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট, পড়ছে নিউ জার্সি স্টেট কলেজে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। জামাই ডাক্তার। সম্প্রতি এফআরসিএস করেছে। এখন আছে পিজিতে। লীনা দ্বিতীয় মেয়ে। ম্যাট্রিকে চারটা লেটার এবং স্টার মার্ক নিয়ে ছেলেমেয়ে সবার মধ্যে ফিফথ হয়েছে। আইএ তে খুব ভালো করতে পারেনি। সায়েন্স থেকে আর্টস-এ আসায় একটু অসুবিধা হয়েছে। তবু ফাস্ট ডিভিশন ছিল। এখন পড়ছে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। হলে থাকে। গরমের ছুটি কাটাতে এসেছে। ছোট মেয়েকে শান্তিনিকেতনে দিয়েছিলেন। কলাভবনের ছাত্রী। তবে ওর সেখানে থাকতে ভাল লাগছে না। গরমের সময় খুব গরম পড়ে। মেয়ের আবার গরম সহ্য হয় না।
ফেরার পথে লীনা তাকে গাড়িতে তুলে দিতে এল। নরম গলায় বলল, মা নিজেদের কথা বলতে খুব পছন্দ করেন। আপনি আবার কিছু মনে করলেন না তো?
আসিফ বলল, না। কিছু মনে করিনি।
আমি আপনার জন্যে একটা উপহার এনেছি। সবার সামনে দিতে লজ্জা লাগল। আপনি যদি এটা নেন আমি খুব খুশি হব। আপনার অভিনয় আমার কি যে ভাল লেগেছে। অনেক’দিন ধরেই আমার মনটা অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে ছিল। হঠাৎ সেখানে এক ঝলক আলো পড়ল। খুব কাব্য করে কথা বলে ফেলেছি। কিছু মনে করবেন না, এই নিন।
শাড়ির আঁচলের ভাঁজ থেকে লীনা কালো রঙের কি যেন বের করল। আসিফ বলল, এটা কি?
নটরাজের একটা মূর্তি। আমার ছোটবোন শান্তিনিকেতন থেকে আমার জন্যে এনেছিল। আমার খুব প্রিয়। আপনি নিন। আপনার টেবিলে সাজিয়ে রাখবেন। প্লিজ, প্লিজ।
তখন আসিফের বয়স ছিল অল্প। হৃদয় আবেগে পরিপূর্ণ। রাতটাও ছিল অন্য রকম। চৈত্র মাসের রহস্যময় রাত। চারদিকে উথালি পাথাল চাঁদের আলো। পাশে নটরাজের মূর্তি হাতে দেবীর মত এক তরুণী। তরুণীর কণ্ঠস্বর বড় স্নিগ্ধ। আসিফের চোখে জল এসে গেল। সেই জল গোপন করার কোনো চেষ্টা সে করল না। কেন যেন তার মনে হল, এই নারীর কাছে তার গোপন করার কিছুই নেই। এই নারী সর্বজ্ঞ ঈশ্বর।
নটরাজের মূর্তি আসিফ নিজের কাছে রাখেনি। রুপার মেডেলের মত মূর্তিটি সে কৃয়ায় ফেলে দিয়েছিল। কেন সে এটা করল? পৃথিবীর মতো, চৈত্র মাসের চাঁদের মত, গহীন অরণ্যের মত মানুষও রহস্যময়।
ঘুমুচ্ছিস নাকি রে আসিফ?
আসিফ চমকে উঠল। সে প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিল। তার বেশ লজ্জা লাগছে। ভাগ্নির এত বড় একটা অপারেশন হচ্ছে, আর সে কি না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিচেচ্ছ। রেহানা বললেন, অপারেশন হয়ে গেছে। পুতুল ভালো আছে। জ্ঞান ফিরেছে, কথা-টথা বলল।
‘বাহ চমৎকার তো! তুমি এখন রেস্ট নাও আপা। খুব ধকল গেছে।
রেহানা ক্লান্ত ভঙ্গিতে আসিফের পাশে বসল। ক্লিনিকের এই ঘরটা এখন প্ৰায় ফাঁকা। আত্মীয়স্বজন যারা এসেছিল সবাই চলে গেছে। আসিফের মেঝ বোন এখনো আছে। সে দাড়িয়ে আছে ইনটেনসিভ কেয়ার ঘরটার পাশে। তারও চলে যাবার কথা। গাড়ি গিয়েছে। একজনকে নামিয়ে দিতে। গাড়ি এলেই সেও চলে যাবে। এখানে থাকার আর কোনো মানে হয় না।
রেহানা বলল, আসিফ তুই কী করবি? থাকবি না চলে যাবি?
আমার অসুবিধা নেই, থাকতে পারি।
তোর খিদে লেগেছে বোধ হয়। রাতে তো খাসনি।
না খিদে লাগেনি।
তোর বউ কেমন আছে?
ভালই।
অনেক দিন দেখি না। তোরা আসিস না কেন?
ব্যস্ত থাকি।
নাটক নিয়ে ব্যস্ত?
হুঁ।
কে যেন বলছিল— বউকেও নামিয়েছিস। এসব কি কাণ্ড বল তো। নিজে যা করছিস তাই যথেষ্ট, তার ওপর যদি…
আসিফ কিছু বলল না। হাই তুলল। রেহানা বললেন, নাটক নাটক করে তোর লাভটা কি হয়েছে এমন তো না যে দশটা লোক তােকে চেনে। তার তো কিছুই হয়নি।
তা ঠিক।
এই জীবনের কোথাও স্থির হতে পারলি না। আজ এই চাকরি, কাল ঐ চাকরি। তোর বয়স হচ্ছে না?
হচ্ছে।
বয়স হলে মানুষের একটা সিকিউরিটির দরকার হয়। একটা বাড়ি। কিছুটাকা পয়সা… তোর আছে কি?
এইসব বাদ দাও।
‘বাদ দাও বললেই বাদ দেয়া যায়? এই যে পুতুলের অপারেশন হল – বারো-তের হাজার টাকা খরচ হয়েছে। টাকা ছিল বলে খরচ করতে পেরেছি। যদি না থাকত? তোর এই রকম কিছু হলে তুই কি করবি?
কি আর করব? হাসপাতাল যাব। বিনা পয়সায় চিকিৎসার চেষ্টা করব।
তুই হয়ত ভাবিস তোকে নিয়ে আমরা চিন্তা-ভাবনা করি না। এটা ঠিক না। প্রায়ই আমাদের বোনদের মধ্যে আলোচনা হয়। খুবই কষ্ট লাগে।