কারাধ্যক্ষ মাওয়া শুকনো মুখে তাকাল।
তোমার নাম খুব সম্ভব মাওয়া। ঠিক না?
মাওয়া মাথা নাড়ল।
এত বিমর্ষ হয়ে আছ কেন? দশ বছর আগে তোমার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। পুরোনো পরিচয়ের সূত্রেও একটু হাস।
মাওয়া হাসির মতো ভঙ্গি করল। নিশো বললেন, তোমারও দেখি বয়স হয়েছে। নিচের পাটির দাঁত পড়ে গেছে। আমার ধারণা, শুধু আমার একারই বয়স হচ্ছে। হা হা হা।
মাওয়া শান্ত স্বরে বলল, আমার দুর্ভাগ্য স্যার, আবার আপনাকে এই অবস্থায় দেখলাম।
নিশো মাওয়ার কথার কোনোরকম গুরুত্ব দিলেন না। সহজভাবেই নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র চাইলেন। শুধুমুখে চাওয়া নয়, লিখিতভাবে চাওয়া। গোটাগোটা অক্ষরে লিখলেন
০ খবরের কাগজ
০ ট্রানজিস্টার রেডিও (মাল্টি ব্যান্ড)
০ লেখার কাগজ
০ চুরুট (ভালো চুরুট)
০ কফি (ইন্সট্যান্ট কফি নয়)
০ জন স্টেইনবেকের সুইট থার্ড ডে উপন্যাস।
০ এ্যারেন পাউলের কালো মানুষদের কবিতা।
মাওয়া বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, লেখার কাগজ, চুরুট এবং কফি ছাড়া অন্য কিছুই দেওয়া যাবে না। আপনি স্যার কিছু মনে করবেন না।
আমি কখনো কিছু মনে করি না। বই দুটি কি দেওয়া যাবে?
এই জঙ্গলে বই কোথায় পাব?
ঠিক আছে।
আপনার সেবার জন্যেও কাউকে দেওয়া যাচ্ছে না। একমাত্র আমিই আসব আপনার কাছে। দিনে এক বার আসব।
ভালো, তবে এমন গোমড়া মুখে আসবে না। হাসিমুখে আসবে। আমাদের এমনিতেই অনেক দুঃখ-কষ্ট আছে। এর মধ্যে গোমড়া মুখ দেখতে ইচ্ছা করে না। যদিও মাওয়া বলেছিল, খবরের কাগজ ট্রানজিস্টার রেডিও এসব কিছুই দেওয়া হবে না, তবুও মাওয়া মধ্যাহ্নকালীন খবরের কিছু আগে একটি ছোট ট্রানজিস্টার নিয়ে নিশোর কাছে গেল—ভয়ার্ত স্বরে বলল, আপনার প্রসঙ্গে একটি খবর প্রচারিত হয়েছে। সকাল এগারটায়। এখনো বোধহয় আবার বলবে। নিশো মুচকি হেসে বললেন, মজার খবর নাকি? মাওয়া কোনো জবাব দিল না।
নিশো মোরান্ডা বেতারের খবর শুনলেন শান্ত ভঙ্গিতে। মাঝেমাঝে চুরুটে টান দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উত্তেজনা তাঁর আচার-আচরণে প্রকাশ পেল না।
আমরা গভীর দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি—মোরান্ডার প্রিয় মানুষ জুলিয়াস লিম্বানি। নিশো আজ ভোর চার ঘটিকায় আলজেরিয়াতে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। জেনারেল ডোফাপরলোকগত জননেতার শোকসন্তপ্ত পরিবারের কাছে এক শোকবাণীতে জানান-জুলিয়াস লিম্বানি নিশোর মৃত্যু শুধু মোরান্ডার নয়, সমগ্র পৃথিবীর জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। জুলিয়াস লিম্বানি নিশোর বিদেহী আত্মার প্রতি সম্মান জানানোর উদ্দেশে আগামী তিন দিন রাষ্ট্ৰীয় শোকদিবস হিসেবে পালন করা হবে। বিদেশে অবস্থিত মোরান্ডার দূতাবাসগুলিতে এই উপলক্ষে শোক-বই খোলা হয়েছে। রাজধানীর প্রতিটি ভবনে পতাকা অৰ্ধনমিত রাখা হয়েছে।
জুলিয়াস নিশো হালকা স্বরে বললেন, ফোটনকেও কি পতাকা অৰ্ধনমিত? মাওয়া হা-সূচক মাথা নাড়ল। নিশো মাথা নিচু করে হাসলেন।
অল্পবয়সী মেয়েরা সহজেই হতাশ হয়
অনেকক্ষণ ধরে ফোন বাজছে।
ফকনার বসে আছে পাশেই, কিন্তু রিসিভার তুলছে না। কানের পাশে ফোন বাজা একটি বিরক্তিকর ব্যাপার। কিন্তু লোকটি বিরক্ত হচ্ছে না। নির্বিকার ভঙ্গিতে সিগারেট ফুকছে। মাঝেমাঝে ভুরু কোঁচকাচ্ছে, যা থেকে মনে হতে পারে কোনো–একটি বিষয় নিয়ে সে চিন্তিত।
হার্ভি ফকনার হচ্ছে সেই জাতীয় লোক, যাদের বয়স বোঝা যায় না। এর জুলফির সমস্ত চুল পাকা। বয়স চল্লিশ থেকে পঞ্চান্নর মধ্যে হতে পারে। মাঝারি আকৃতির মানুষ। রোদে পোড়া তামাটে গায়ের রঙ। চোখ দুটি অস্বাভাবিক ছোট। বিড়ালের চোখের মতো জ্বলজ্বলে। সমস্ত মুখাবয়বে একটি ছেলেমানুষি ভাব আছে, তীক্ষ চোখের কারণে যা ্কখনো স্পষ্ট হয় না।
টেলিফোন বেজেই যাচ্ছে। ফকনার রিসিভার এক বার তুলেই নামিয়ে রাখল। যদি ওপক্ষের প্রয়োজন খুব বেশি হয় আবার করবে।
প্রয়োজন বেশ আছে মনে হচ্ছে। আবার টেলিফোন বাজছে। ফকনার সিগারেটে শেষ টান দিয়ে রিসিভার তুলল।
হ্যালো।
হার্ভি ফকনার?
কথা বলছি।
আমি কি আপনার সঙ্গে একটি জরুরি বিষয় নিয়ে আলাপ করতে পারি?
তার আগে আপনার নাম বলুন।
নাম বললে আপনি আমাকে চিনতে পারবেন না।
আমি অপরিচিত কারো সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলি না।
ফকনার নির্বিকার ভঙ্গিতে টেলিফোন নামিয়ে রাখল। এটা প্রায় নিশ্চিত, লোকটি আবার টেলিফোন করবে। প্লাগ খুলে রাখলে কেমন হয়? ফকনার দ্বিতীয় বার সিগারেট ধরিয়ে বাথরুমে ঢুকল। দু দিন শেভ করা হয় নি। গালভর্তি নীলচে দাড়ি। হেমিংওয়ের মতো দাড়ি রাখার একটা পরিকল্পনা ছিল। এখন মনে হচ্ছে সেটা সম্ভব নয়, গাল চুলকাচ্ছে। কিন্তু দাড়িগুলির ওপর একটি মায়া পড়ে গেছে। থাকুক না-হয় কিছুদিন, তারপর দেখা যাবে। ফকনার আয়নায় নিজের ছবির দিকে তাকাল। লোকটিকে চেনা যাচ্ছে না, যেন অপরিচিত কেউ।
টেলিফোন আবার বাজতে শুরু করেছে। বাজুক। তার এমন কোনো ঘনিষ্ঠ মানুষ নেই, যারা এরকম সাত-সকালে ব্যাকুল হয়ে টেলিফোন করবে। ফকনার মনেমনে বলল, আই হ্যাপেন্ড টু বি এ লোনলি ম্যান। কার কবিতা যেন এটা? এ্যান্থনি স্কীলম্যান?
মনে পড়ছে না। স্মৃতিশক্তি আগের মতো নেই। বাথরুমের বেসিনে গত রাতের অভুক্ত খাবারসুদ্ধ প্লেট পড়ে আছে। দূষিত একটা গন্ধ চারদিকে। মেঝেতে তিনটি বিয়ারের খালি ক্যান। লোনলি ম্যান হবার অনেক রকম ঝামেলা।