এই লোকটির কাজকর্ম ঘড়ি-ধরা। রাত সাড়ে দশটায় ঘুমুতে যান। ভোর পাঁচটার মধ্যে জেগে ওঠেন। ছটা না-বাজা পর্যন্ত জগিং করেন। এই এক ঘন্টায় দশ থেকে পনের মাইল রাস্তা দৌড়ানোর পর প্রাতঃকালীন স্নান সারেন। সে একটি দর্শনীয় ব্যাপার। ঘোড়া যেভাবে দলাইমলাই করা হয় সেভাবে দুজন মানুষ তাঁকে দলাইমলাই করতে থাকে। এর ফাঁকে ফাঁকে বরফশীতল জল বালতি-বালতি তাঁর মাথায় ঢালা হয়। স্নানের বিশাল পর্বটি সমাধা হয় চেয়ারে বসে। বাথটাব, হট শাওয়ার বা স্টিমবাথজাতীয় আধুনিক স্নানের প্রক্রিয়া এই আফ্রিকান জেনারেলকে মোটও আকর্ষণ করতে পারে নি।
আজ তাঁর রুটিনের ব্যতিক্রম হয়েছে। তিনি সারা রাত এক ফোঁটাও ঘুমোন নি। একটি বিশেষ খবরের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। ভোর পাঁচটা সাতাশ মিনিটে তাঁর এডিসি এসে জানাল, জায়ার হেলিকপ্টার নির্বিঘ্নে ফোটনকে অবতরণ করেছে, এবং পূর্ব পরিকল্পনামত জুলিয়াস নিশোর পরিচয় গোপন আছে। ফোর্টের দু জনমাত্র ব্যক্তি এই পরিচয় জানেন, এক জন ফোর্টের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার অন্যজন কারাধ্যক্ষ মাওয়া। জেনারেল ডোফা শীতল স্বরে বললেন, অন্য কেউ জুলিয়াস নিশোর সংবাদ জানে না, এই সম্পর্কে তুমি কত ভাগ নিশ্চিত?
এক শ ভাগ স্যার। জলিয়াস নিশোকে তাঁর সেলে নেওয়া হয়েছে। সেই সেলের আশেপাশে কারাধ্যক্ষ মাওয়া ছাড়া আর কেউ যেতে পারবে না, এই মর্মে নির্দেশ জারি করা হয়েছে।
সেলটি পাহারা দিচ্ছে কারা?
আপনার নির্দেশমতই ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রেসিডেন্টের সিকিউরিটি রেজিমেন্টের ওপর বন্দির নিরাপত্তার ভার দেওয়া হয়েছে।
জেনারেল ডোফা উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, কৌতূহলী সৈন্যরা বন্দির পরিচয় জানতে আগ্রহী হবে। হবে না?
হয়তো হবে। কিন্তু স্যার, প্রেসিডেন্টের সিকিউরিটি রেজিমেন্টের জোয়ানদের কৌতূহল কম।
তা ঠিক। জুলিয়াস নিশোর শরীর কেমন?
একটু দুর্বল। কিন্তু শরীর ভালোই আছে।
তাঁর খাওয়াদাওয়া, অষুধপত্র-এ সমস্ত ব্যাপারগুলির প্রতি বিশেষ লক্ষ রাখার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তো?
হয়েছে। আপনার নির্দেশের কথা আমি মাওয়াকে বলেছি।
ভালো। কফি দিতে বল।
ডোফা পরপর দু কাপ কফি খেলেন। জায়ার পররাষ্ট্র দপ্তরের সচিবকে ডেকে পাঠালেন। তিনটি ছোট-ঘোট চিঠি লিখলেন। জায়ারে অবস্থিত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে তাঁর একটি জরুরি সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করবার নির্দেশ দিলেন। খানিকক্ষণ নীরবে ধূমপান করবার পর এডিসিকে আবার ডেকে পাঠালেন।
তুমি নিশ্চয়ই জান, আজ বেলা ১০টায় জায়ার বেতার থেকে জুলিয়াস নিশোর মৃত্যুসংবাদ প্রচার করা হবে?
জানি স্যার। কিন্তু আজ দশটায় প্রচার করা হবে সেটা জানতাম না।
এগারটায় মোরান্ডা বেতার থেকে এই সংবাদ প্রচার করা হবে। সেখানেই বলা হবে এই বৰ্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও দার্শনিকের মৃত্যুতে আমি, জেনারেল ডোফা, তিন দিনব্যাপী রাষ্ট্ৰীয় শোক ঘোষণা করেছি। এডিসি কিছু বলল না। তার মুখ ভাবলেশহীন। ডোফা বললেন, বেলা বারটায় একটি হেলিকপ্টার জুলিয়াস নিশোর শবাধার নিয়ে মোরান্ডায় পৌঁছবে, এবং রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে।
সেই শবাধারে কোনো শব থাকবে না?
নিশ্চয় থাকবে। তবে তা জলিয়াস নিশোর নয়। সেই শবাধারের ঢাকনা খোলা হবে না, কাজেই কার শব সেটা নিয়ে কারোর মাথাব্যথা হবার কথা নয়। তুমি কি কিছু বলতে চাও?
না।
তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে কিছু বলতে চাও। বলে ফেল।
স্যার, এতটা ঝামেলার কোন দরকার ছিল কি? সরাসরি জুলিয়াস নিশোর মৃতদেহ নিয়ে গেলেই হত।
না, হত না। জুলিয়াস নিশো কোনো সামান্য ব্যক্তি নন। তাঁর মৃত্যুতে পৃথিবীজুড়েই একটা হৈচৈ হবার কথা। তাতে আমার কিছুই যায়-আসে না। কিন্তু আমি যেটা ভয় পাচ্ছি সেটা হচ্ছে, মৃত্যুসংবাদ প্রচারিত হবার সঙ্গে-সঙ্গে খোদ মোরান্ডাতে একটা গৃহবিপ্লব শুরু হতে পারে।
যদি শুরু হয়, তাহলে কি আপনি দ্বিতীয় বার একটি ঘোষণা দেবেন যে, জুলিয়াস নিশো বেঁচে আছেন?
হ্যাঁ, দেব। কারণ সত্যি-সত্যি গৃহযুদ্ধ শুরু হলে একমাত্ৰ নিশোই তা থামাতে পারবেন।
তার মানে কি এই যে, জুলিয়াস নিশোর মৃত্যুদণ্ড দিতে আপনি ভয় পাচ্ছেন?
হ্যাঁ, পাচ্ছি। জেনারেল ডোফা এই পৃথিবীতে দুটি মানুষকে ভয় পায়। প্রথম জনের নাম জুলিয়াস নিশো।
দ্বিতীয় জন কে?
দ্বিতীয় জনের নাম তোমার না জানলেও চলবে। আমি আবার কফি খাব, তুমি কফি দিতে বল।
সাড়ে ছটা বাজে, আপনার ব্রেকফাস্ট দেওয়া হয়েছে।
তোমাকে কফির ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে, সেটা কর। আমি কোনো কথাই দ্বিতীয় বার বলা পছন্দ করি না।
ফোর্টনকের যে-সেলটিতে জুলিয়াস নিশোকে রাখা হয়েছে, তার একটি বিশেষ নাম আছে-না-ফেরা ঘর। এ-ঘর থেকে কেউ কখনো ফেরে না। মোরান্ডার খ্যাত। অখ্যাত বহু মানুষ এ-ঘরে ঢুকেছেন, কেউ বেরুতে পারেন নি। জুলিয়াস নিশোর ব্যাপারে একটি ব্যতিক্রম আছে, তিনি দশ বছর আগে এক বার ঢুকেছিলেন। পঞ্চম দিনে গৃহযুদ্ধ বেধে গেল, সপ্তম দিনে জুলিয়াস নিশোকে ঘর থেকে বের করে আনতে হল গৃহযুদ্ধ থামাবার জন্যে। এর মধ্যেই মাউ উপজাতির এক-পঞ্চমাংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। এরা অত্যন্ত সাহসী মানুষ। মোরান্ডা সেনাবাহিনীর ওপর তারা বড় রকমের আঘাত করেই মারা গেল। সেসময় মাউ উপজাতীয়দের মধ্যে বিদ্যুতের মতো যেকথাটি ছড়িয়েছিল, তা হচ্ছে -নিশোর জন্যে একটি প্রাণ দিন। তিনি আবার তা ফিরিয়ে দেবেন। দশ বছর অনেক দীর্ঘ সময়। এই সময়ে অনেক কিছুই বদলে যায়। নিশোও বদলেছেন। সেসময় তাঁর মাথাভর্তি চুল, চোখের দৃষ্টি ছিল তীক্ষ। এখন মাথায় একগাছিও চুল নেই। ভারি চশমা ছাড়া দশ হাত দূরের মানুষটিকে চিনতে পারেন না। তবু কিছু কিছু জিনিস আছে, যা সময়ের সঙ্গে বদলায় না। যেমন স্বভাব। নিশো ঠিক আগের বারের মতোই হাসিমুখে বললেন, সুপ্রভাত, সুপ্ৰভাত।