কয়েকটা মাছি তাঁকে বিরক্ত করছে। এটাও বেশ মজার ব্যাপার। মাছিগুলি অন্য কাউকে বিরক্ত করছে না। বারবার উড়ে এসে তাঁর মুখে বসছে। কীটপতঙ্গরা মানুষের মৃত্যুর খবর আগে টের পায়। এরাও হয়তো পেয়ে গেছে। নয়ত বেছে-বেছে তাঁর মুখের ওপরই ভভ করবে কেন?
নিশো দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। পানির পিপাসা হচ্ছে। আশেপাশে কেউ নেই, যাকে পানির কথা বলা যায়। চেচিয়ে কাউকে ডাকার মত জোর তাঁর ফুসফুসে নেই। তিনি মড়ার মতো পড়ে রইলেন। তাঁর মুখের ওপর মাছি ভভ করছে। কী কুৎসিত দৃশ্য। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে কুৎসিত দৃশ্যের পাশাপাশি একটি চমৎকার দৃশ্যও তাঁর চোখে পড়ল পিপুল গাছের মোটা শিকড়ে একটি পাহাড়ী পাখি। ঝকঝকে সোনালি পাখা। চন্দনের দানার মতো লাল টকটকে ঠোঁট। কী নাম এই পাখির, কে জানে। পাখিটা তাঁকে কৌতূহলী চোখে দেখছে। আহ্, বেঁচে থাকার মধ্যে কত রকম আনন্দ। কত অপ্রত্যাশিত মুহূর্ত।
সম্রাট নিশো।
তিনি পাখির ওপর থেকে দৃষ্টি না-ফিরিয়েই বললেন, আমি শুনছি।
আপনি কেমন বোধ করছেন?
এই মুহূর্তে, চমৎকার বোধ করছি।
শুনলাম কিছুই খান নি।
ইচ্ছা করছে না।
দয়া করে আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলুন।
নিশো তাকালেন।
আমার নাম ফকনার।
তুমি এই দলের প্রধান?
হ্যাঁ। আমি জানতে এসেছি আপনার কিছু লাগবে কি না।
কাগজ এবং কলম দিতে পার? পাখিটা দেখার পর চমৎকার একটা ভাব এসেছে। চেষ্টা করব ভাবটা ধরে রাখতে পারি কি না।
কবিতা লিখবেন?
আবেগ ধরে রাখবার জন্যে কবিতা হচ্ছে শ্রেষ্ঠতম মাধ্যম।
আপনার কি মনে হচ্ছে না, কাব্যচর্চার জন্যে সময়টা উপযোগী নয়?
না, তা মনে হচ্ছে না।
কাগজ-কলমের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না বলে দুঃখিত। আমি অন্য একটি ব্যাপার জানতে এসেছি।
কি ব্যাপার?
এ-দেশের লোকজন কি আপনাকে ভালবাসে?
মনে হয় বাসে।
কি করে বললেন?
আমি ওদের ভালবাসি। ভালবাসা এমন একটি ব্যাপার যে, যাকে ভালবাসা হয় তাকে তা ফেরত দিতে হয়। এখানে বাকি রাখা চলে না। তুমি যখনি কাউকে ভালবাসবে তখনি তা ফেরত দিতে হবে। এবং মজার ব্যাপার কি, জান? অনেক বেশি পরিমাণে ফেরত আসে। তা-ই নিয়ম।
কার নিয়ম?
প্রকৃতির নিয়ম।
নিশো দেখলেন, ফকনার চলে যাচ্ছে। তিনি তাকালেন পাখিটির দিকে। আশ্চর্য, পাখিটা এখনো আছে, উড়ে যায় নি। তিনি মৃদুস্বরে বললেন, এই আয়, কাছে আয়। পাখিটা তখন উড়ে গেল। এই ব্যাপারটাও তাঁর বেশ মজা লাগল। যতক্ষণ পাখিটাকে কাছে আসতে বলেন নি, ততক্ষণ সে কাছেই ছিল। যেই কাছে ডেকেছেন অমনি উড়ে গেছে।
সম্রাট নিশো।
কে?
আমার নাম জনাথন—মিঃ ফকনার আপনার জন্যে কাগজ এবং কলম পাঠিয়েছেন।
ধন্যবাদ। অসংখ্য ধন্যবাদ।
ফকনার দাঁড়িয়ে আছে
ফকনার দাঁড়িয়ে আছে ওয়্যারলেস সেটের পাশে। ওয়্যারলেস অপারেটর হচ্ছে বেঁটে এ। যার আসল নাম অ্যালবার্ট জিরান। সে মোটই বেঁটে নয়—প্রায় ছ ফুটের মতো লম্বা। তার বেঁটে খেতাবের উৎস রহস্যমণ্ডিত।
বেঁটে এ ওয়্যারলেস সেটের নব ঘোরাচ্ছে। কমুনিকেশন ফ্রিকোয়েন্সির নব ঘোরাচ্ছে, যদি কিছু ধরা পড়ে। কিছুই ধরা পড়ছে না। জেনারেল ডোফা এদের সঙ্গে যোগাযোগর প্রয়োজন এখনো বোধ করেন নি। তবে শিগগিরই হয়তো করবেন। জেনারেল ডোফা চেষ্টা করবেন তাদের ঘিরে ফেলতে। তাঁকে অতি দ্রুত সৈন্য সমাবেশ করতে হবে। প্যারাট্রুপার নামাতে হবে হয়তো। ফোর্টনক এবং এই পরিত্যক্ত এয়ারপোর্ট ছাড়া প্যারাট্রুপার নামাবার জায়গা নেই। গাছপালায় চারদিক ঢাকা।
ওয়্যারলেস সেট বিপ-বিপ করছে। ফকনার বলল, বেঁটে এ, কিছু আসছে?
মনে হচ্ছে। সিগন্যাল ক্লিয়ার না। প্রচুর ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ।
চেষ্টা করে যাও। এফ এম এ দেখবে কিছু পাওয়া যায় কি না?
এল ইশারায় চুপ করতে বলল। সিগন্যাল পাওয়া যাচ্ছে। পরিষ্কার সিগন্যাল।
হ্যালো হ্যালো…….ব্রিগেডিয়ার ক্রিন্তা। হ্যালো।
অ্যালবোর্ট জিরান।
মিশন ফোর্টনক? হ্যালো, ফোর্টনক?
ফকনার এগিয়ে এল। ক্লান্ত গলায় বলল, ফকনার কথা বলছি–ব্রিগেডিয়ার ক্ৰিন্তা, সুপ্ৰভাত।
সুপ্রভাত কি না বোঝা যাচ্ছে না।
তোমাদের জন্যে তো সুপ্রভাত বটেই।
ফকনার বিস্মিত ভঙ্গি করল, যেন খুবই অবাক হয়েছে।
আমি যা বলব তুমি তা করবে না?
আমরা কেউ করব না।
বহুবচনে কথা বলছ কেন? তুমি তোমার নিজের কথা বল। যা করতে বলব তা করবে না?
না।
খুবই ভালো কথা। সাধাসাধি আমার পছন্দ না। ভয় দেখিয়ে রাজি করানোতেও আমার বিশ্বাস নেই। আমি সহজ-সরল লোক। যেহেতু তুমি আমার কোনো কাজে আসছ না, কাজেই তোমাকে বাঁচিয়ে রাখার কোনো যুক্তি দেখছি না।
ফকনার ঠোঁটের সিগারেট খুঁড়ে ফেলে দুপা এগিয়ে খাপ থেকে পিস্তল টেনে বের করল। তার মুখের রেখা একটুও বদলাল না। ঠোঁটের ফাঁকে যে-হাসি লেগে ছিল, সেই হাসি লেগে রইল। পরপর দুবার গুলির শব্দ হল। শব্দ মেলাবার সঙ্গে-সঙ্গেই তার শান্ত গলা শোনা গেল, বেঁটে এল, ডেডবডি সরিয়ে নিয়ে যাও। আর এদের কফি দেওয়ার ব্যবস্থা কর। তোমরা যারা এখনো বেঁচে আছ, তাদের বলছি—কোনো রকম জোরজবরদস্তি নেই। আমার কথা যারা শুনতে চাও না, তাদের শুনতে হবে না। তবে যারা শুনবে তারা ভালোমতো শুনবে এইটুকু আশা করি।
মাওয়া ভাঙা-ভাঙা গলায় বলল, জেনারেল ডোফাকে কি বলতে হবে?
বলছি। তার আগে কফিপর্ব শেষ হয়ে যাক।
নিশো একদৃষ্টে এদের দিকে তাকিয়ে আছেন। এত দূর থেকে কথাবার্তা তিনি কিছুই শুনতে পান নি। হত্যার দৃশ্যটি শুধু দেখেছেন। এত সহজে, এত শান্ত ভঙ্গিতে মানুষ খুন করা যায়, তা তাঁর কল্পনাতেও ছিল না। তিনি শব্দ করে বমি করলেন। তাঁর নাড়িতুড়ি যেন উঠে আসতে চাইছে। মনে-মনে বললেন, হে ঈশ্বর, এ কী দেখলাম। তাঁর মনেই রইল না যে তিনি ঈশ্বর বিশ্বাস করেন না। স্বৰ্গ-নরক বিশ্বাস করেন না।
জেনারেল ডোফা বিস্মিত
জেনারেল ডোফা বিস্মিত গলায় বললেন, মাওয়া, তুমি যা বলছ তা কি সত্যি?