মেয়েলি স্বভাব থোক বা না-হোক, আমি পরিষ্কারভাবে জানতে চাই-তুমি কি ভাবছ?
এই মুহূর্তে আমি কি ভাবছি, জানতে চাচ্ছ?
হ্যাঁ।
এই মুহূর্তে আমি ভাবছি, এক কাপ গরম কফি পেলে মন্দ হয় না।
রসিকতা করছ?
না, রসিকতা করব কেন? সত্যি-সত্যি কফির পিপাসা বোধ হচ্ছে। সবার জন্য গরম কফির ব্যবস্থা কর। সেই সঙ্গে খাবারদাবার। শীতকালের নেকড়ের মতো ক্ষুধার্ত বোধ করছি।
এর বেশি তোমার কিছু বলার নেই।
আপাতত না।
কফি কি আমরা এই এয়ারপোর্টেই খাব?
মন্দ কি?
এরকম একটা খোলামেলা জায়গায়?
অসুবিধা কি?
দেখ ফকনার, তোমার বুদ্ধির ওপর আমি চিরকাল আস্থা রেখেছি। তবুও বলছি, তোমার কি মনে হয় না জেনারেল ডোফা বিমান থেকে একটা আক্রমণ চালাতে পারে?
মনে হয় না। ডোফার কথাবার্তা বোকার মতো, কিন্তু সে তোমার মতই বুদ্ধিমান। কাঁচা কাজ করবে না। আলাপ-আলোচনায় বসবে।
কিসের আলোচনা?
ডোফা আমাদের সঙ্গে একটা চুক্তিতে আসতে চাইবে বলে আমার ধারণা। সে আমাদের অক্ষত অবস্থায় এ-দেশ থেকে চলে যেতে দেবে, তার বদলে নিশোকে ওদের হাতে তুলে দিতে হবে। হরতনের টো আমাদের হাতে।
তাসের কিছু-কিছু খেলায় হরতনের টেক্কা মূল্যহীন।
নিশো মূল্যহীন নয়। সেটা তুমি জান, আমি জানি, জেনারেল ডোফাও জানে। নিশা যতক্ষণ আমাদের হাতে আছে ততক্ষণ ভয় নেই। ব্যাটা বেঁচে আছে তো?
হুঁ।
বাঁচিয়ে রাখ। নিশো হচ্ছে আমাদের বেঁচে থাকার পাসপোর্ট। ওকে ঠিকমত রাখ।
দ্রুত কফির ব্যবস্থা হল। ফকনার কফির মগ হাতে শান্ত গলায় ছোট্ট একটা বক্তৃতা দিল।
বন্ধুগণ, বুঝতেই পারছ, ক্ষুদ্র একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে। যারা আমাদের এই কাজে লাগিয়েছে, তাদের কাছে আমাদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। আমরা ফাঁদে আটকা পড়ে গেছি। পশুদের জন্য ফাঁদ একটা ভয়াবহ ব্যাপার। এক বার ফাঁদে আটকা পড়লে তারা বেরুতে পারে না।……
সৌভাগ্যক্রমে আমরা পশু নই, মানুষ, এবং বুদ্ধিমান মানুষ। ফাঁদ কেটে বেরিয়ে আসব। আপাতত আমরা যা করব, তা হচ্ছে কভার নেব। যাতে অনুসন্ধানী বিমান আমাদের দেখতে না পায়। কারো কি এই প্রসঙ্গে বলার আছে?
এক জন হাত তুলল। ফকনার বলল, কী বলার আছে?
আমাদের মধ্যে যাদের যাদের বাথরুম পেয়েছে, তারা কি বাথরুমের কাজটা এয়ারপোর্টে সারতে পারি? এদের এখানে ভালো বাথরুম আছে।
সবাই হা-হা করে হেসে উঠল। হাসি আর থামতেই চায় না। ফকনার আরেকটি সিগারেট বের করতে-করতে মনে-মনে বলল, দলটা ভালো। এদের বিশ্বাস করা যায়। এদের উপর ভরসা করা যায়।
বাথরুম সারবার জন্যে দশ মিনিট সময় দেওয়া হল। ডিসমিস।
আফ্রিকার মতো দেশ
কভার নেবার জন্য আফ্রিকার মতো দেশ হয় না। ঘন বনের দেশ। পুরো এক ডিভিশন সৈন্য ছোট্ট বনের মধ্যে লুকিয়ে পড়তে পারে। বিমান থেকে তাদের খোঁজা অসম্ভব। জায়গায়-জায়গায় খানাখন্দ গিরিখাত। আদর্শ কভার।
ফকনারের দল এয়ারপোর্টের উত্তরের বনে ঢুকে পড়ল। দলের কাউকেই তেমন চিন্তিত মনে হল না। অনেকেই পছন্দসই জায়গা বেছে ঘুমুবার আয়োজন করছে। দুজনের একটা দল তাস নিয়ে বসেছে। আলো ভালো মতো ফোটে নি। তাস দেখা যাচ্ছে না। তাতে খেলায় অসুবিধা হচ্ছে না। তাই স্টেকের খেলা। দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে টাকার হিসাব রাখা হচ্ছে। সকলের ইন্দ্ৰিয় তাসে কেন্দ্ৰীভূত।
এরকম পরিস্থিতিতে যে-জাতীয় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা সাধারণত থাকে, তার কিছুই নেই। সবই কেমন যেন আলগা ধরনের। সবার মধ্যে কেমন টিলালা ভাব। যেন আফ্রিকার বনে তারা সাপ্তাহিক বনভোজনে এসেছে। কারোর চেহারায় উদ্বেগের বিন্দুমাত্র ছাপ নেই। শুধু বেন ওয়াটসনকে খানিকটা ক্লান্ত মনে হচ্ছে।
সে বিশাল এক পিপুল গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে বসেছে। নিশো আছে তার পাশে। নিশোর হতভম্ব ভাব এখনো কাটে নি। এখন পর্যন্ত তিনি একটি কথাও বলেন নি। কফি দেওয়া হয়েছিল। খান নি, ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাঁর শরীর খুবই খারাপ লাগছে। কিছুক্ষণ আগে বমি করেছেন। যেভাবে চোখ বন্ধ করে পড়ে আছেন, তাতে মনে হচ্ছে মৃত্যু আসন্ন। এখনি হয়তো হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসবে, কয়েক বার হেঁচকি তুলে সবরকম সমস্যার সমাধান করে দেবেন। এ নিয়েও বেন ওয়াটসনের মাথাব্যথা নেই। সে একটা লম্বা ঘাস দাঁত দিয়ে কাটছে এবং কিছুক্ষণ পরপর কাটা ঘাসের টুকরো থু করে দূরে-দূরে ফেলছে। তার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, তার মূল প্রচেষ্টা ঘাসের টুকরোটা কত দূরে ফেলা যায়।
নিশো একটা কাতর শব্দ করলেন।
বেন বিরক্ত মুখে বলল, কোঁ-কে করবে না। কোঁ-কে শব্দটা আমার খুবই অপছন্দ।
নিশো বললেন, আনন্দের কোনো শব্দ করতে পারলে খুশি হতাম। তা পারছি না।
যখন পারছ না, তখন চুপ করে থাক।
নিশো হেসে ফেললেন।
বেন কড়া গলায় বলল, হাসছ কেন?
মানুষের হাসি শুনে কেউ বিরক্ত হয় না, তুমি হচ্ছ কেন?
বেন উঠে চলে গেল। নিশো কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে রইলেন। অসম্ভব সাহসী একদল মানুষের সঙ্গে তিনি আছেন। সাহস একটি দুর্লভ জিনিস। সেই দুর্লভ জিনিস এদের আছে। কিন্তু সাহসের সঙ্গে আদর্শের চমৎকার মিলটি এদের হয় নি। যে-কারণে তাদের এই সাহস অর্থহীন। থাকাও যা, না থাকাও।
তিনি জানেন, এরা ভাড়াটে সৈন্য। টাকা যার এরা তার। টাকার বিনিময়ে তাকে উদ্ধার করেছে। টাকার বিনিময়ে বিনা দ্বিধায় ডোফার হাতে তুলে দেবে। অবশ্যি তার জন্যে তিনি যে খুব দুঃখিত তা নয়। যার যা চরিত্র, সে তাই করবে। জীবনের শেষ সময়টা তিনি বিনা ঝামেলায় কাটাতে চেয়েছিলেন, তা সম্ভব হচ্ছে না। কষ্ট এই কারণেই। তিনি চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলেন, ডোফার সঙ্গে যদি দেখা হয়, তা হলে তিনি কী বলবেন। বলার মতো তেমন কোনো কথা কি সে-সময় খুঁজে পাওয়া যাবে? তার একটি প্রিয় লাইন হচ্ছে—ম্মাঝে-মাঝে জীবিত মানুষের চেয়ে মৃত মানুষের ক্ষমতা অনেক বেশি হয়। এই লাইনটি বলা যায়। তবে না-বলাই ভালো। এই কথাগুলিতে একধরনের অহঙ্কার প্রকাশ পায়। জীবনের শেষভাগে এসে তিনি অহঙ্কারী সাজতে চান না। কারণ তিনি অহঙ্কারী নন। এটাও বোধহয় ঠিক হল না। তিনি অহঙ্কারী। মানুষ হিসেবে তিনি শ্রেষ্ঠ, এই অহঙ্কার তাঁর আছে।