শীতের ভোরবেলায় গরম কফি চমৎকার লাগছে। বেন ঘড়ি দেখল। ফোর্টনকে। যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।
মাওয়া জেগে উঠল
২৫শে ডিসেম্বর। ভোর ৫-১০।
মাওয়া জেগে উঠল প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণের শব্দে। শব্দ কমে আসতেই সে শুনল একসঙ্গে অনেকগুলি সাব-মেশিনগান থেকে কানে তালা ধরানোর মতো আওয়াজ আসছে। সে-শব্দও থেমে গেল। আলাদা-আলাদাভাবে গুলির শব্দ হতে থাকল। কী হচ্ছে এসব? আবার একটি বিস্ফোরণ। প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। মনে হল ফোর্টনকের সবটাই উড়ে গেছে। দরজা-জানালা সব ভেঙে গেছে নাকি? মাওয়া হতভম্ব হয়ে উঠে বসল বিছানায়, ঠিক তখনি বন্ধ দরজা কে যেন লাথি মেরে ভাঙল।
তুমি মাওয়া?
মূর্তির মতো মাথা নাড়ল মাওয়া।
আমরা নিশোকে নিতে এসেছি। তুমি চাবি নিয়ে আমার সঙ্গে এস।
কিসের চাবি?
কোনো বাজে কথা বলবে না। একটি বাজে কথা বলবে গুলি করে এখানেই শেষ করে দেব।
সাব-মেশিনগান থেকে আবার শব্দ আসছে। একটিমাত্র সাব-মেশিনগান। অনবরত ক্যাটক্যাট শব্দ। ভয়াবহ কিছু-একটা হয়ে গেছে।
মাওয়া অনুগত ছেলের মতো চাবির গোছা হাতে নিচে নেমে এল। সিঁড়ির মাথায় দেখা গেল আরেক জনকে দাঁড়িয়ে থাকতে। সেই লোকটি ভারি গলায় বলল, এই কি মাওয়া?
জ্বি স্যার।
ভালো। মাওয়া, আমি ফকনার। তোমাদের সৈন্যবাহিনীর এমন খারাপ অবস্থা, আমার ধারণা ছিল না। একদল গার্লস-গাইডও তো এর চেয়ে ভালো ডিফেন্স দিত। এইসব অপদার্থদের তো লাথি দিয়ে নদীতে ফেলে দেওয়া উচিত।
সূর্য এখনো ওঠে নি। তবু আবছাভাবে সবকিছু দেখা যাচ্ছে। মাওয়া ভালো-মতো চারদিকে তাকানোরও সাহস পাচ্ছে না। কোথাও কোনো শব্দ হচ্ছে না। শুধু ফ্যামিলি কোয়ার্টারগুলি থেকে মেয়েদের চেচিয়ে কান্নার আওয়াজ আসছে। সৈন্যবাহিনীর ব্যারাক মোটামুটিভাবে একটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। মাওয়া সেলের তালা খুলল। সেলে ঢুকল হার্ভি ফকনার।
সুপ্রভাত জুলিয়াস নিশো।
নিশো কিছু বললেন না। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
আপনি কেমন আছেন?
আমি ভালেই আছি। কিন্তু হচ্ছে কি?
তেমন কিছু না। আমরা আপনাকে নিতে এসেছি।
তোমরা কারা?
আমরা হচ্ছি বুনো হাঁস। আমার মনে হয় না আপনি হাঁটতে পারবেন।
ফকনার ইশারা করতেই এক জন এসে তাঁকে পিঠে তুলে নিল। নিশো মৃদুস্বরে বললেন, অনেক কিছুর পিঠেই চড়েছি, মানুষের পিঠে কখনো চড়ি নি।
ফকনার বলল, আপনাকে অল্প কিছু সময় কষ্ট করতে হবে মিঃ নিশো। ভোর ছটা পঁচিশে আমাদের উদ্ধারকারী প্লেন আসবে। এখানে এমন কিছু কি আছে, যা আপনি সঙ্গে নিতে চান?
না। কয়েকটি প্রেমের কবিতা লিখেছিলাম, সেগুলি আমি মাওয়াকে দিয়ে যেতে চাই।
মাওয়াকে দেওয়া অর্থহীন, ওকে আমি এক্ষুনি মেরে ফেলব।
অসম্ভব। আমার চোখের সামনে কাউকে হত্যা করতে পারবে না।
চোখের আড়ালেই করা হবে।
না না। দয়া কর।
ফকনার হেসে ফেলল।
নিশো চোখ বন্ধ করে উচ্চৈস্বরে বললেন, ঈশ্বর, দয়া কর। বলেই খেয়াল হল—তিনি একজন নাস্তিক। তবু তিনি আবারও ঈশ্বরের নাম নিলেন।
এয়ারপোর্টে সবাই অপেক্ষা করছে
২৫শে ডিসেম্বর। ভোর ৬-২০।
এয়ারপোর্টে সবাই অপেক্ষা করছে। ফকনারের হাতে সিগারেট। তার মুখ হাসি-হাসি। পঞ্চাশ জন মাভোর সবাই আছে। একটা অস্বাভাবিক ঘটনা। বিশ্বাস হয়েও হতে চায় না। কিন্তু এটা স্বপ্ন নয়-সত্যি। ঐ তো জুলিয়াস নিশো চোখ বড়-বড় করে তাকিয়ে আছেন।
ইঞ্জিনের আওয়াজ আসছে। প্ৰেন এসে পডল বোধহয়। রানওয়ে ভালো নয়, তব প্লেনের নামতে বা উঠতে অসুবিধা হবে না। ডাকোটা প্লেনগুলি ধানখেতেও নেমে পড়তে পারে। ফকনার চেচিয়ে উঠল, স্কোয়াড, অ্যাটেনশন। গেট রেডি।
কমান্ডোদের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য জাগল। হ্যাঁ, প্লেন দেখা যাচ্ছে। ডাকোটা প্লেন। ফকনারের নির্দেশে ওয়্যারলেসে প্লেনের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে।
হ্যালো ডাকোটা। বুনো হাঁস কলিং। হ্যালো ডাকোটা, বুনো হাঁস কলিং-ওভার। হ্যালো ডাকোটা।
প্লেনের পাইলটকে শেষ পর্যন্ত ধরা গেল। ফকনার কথা বলবার জন্যে এগিয়ে এল।
গুড মনিং ডাকোটা অ্যান্ড হাপি ক্রিসমাস।
হ্যাপি ক্রিসমাস। কর্নেল ফকনার?
হ্যাঁ।
তোমার জন্যে একটি বড় রকমের দুঃসংবাদ আছে।
বলে ফেল।
আমি তোমাদের নেবার জন্যে নামছি না। কিছুক্ষণ আগেই আমাকে জানানো হয়েছে যে, নিশোকে উদ্ধারের যে-মিশন পাঠানো হয়েছে, তা বাতিল করা হয়েছে।
কেন?
জেনারেল ডোফার সঙ্গে আমেরিকান সরকারের চুক্তি হয়েছে, তারা এখন ডোফাকেই রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে চায়।
ভালো কথা। আমাদের কি হবে?
পাইলট সে-কথার কোনো জবাব দিল না। বিমানটি এয়ারপোর্টের ওপর দুবার চক্কর দিয়ে দক্ষিণ দিকে উড়ে গেল।
সবাই তাকাচ্ছে, কিছু-একটা শুনতে চায় ফকনারের কাছ থেকে। কি বলা যায়? ফকনার আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, বন্ধুরা, চমৎকার একটি সকাল।
রবিনসন ভ্রূ কুঁচকে বলল, ব্যাপারটা কি?
ফকনার জবাব দিল না। এক দল থুথু ফেলল। পকেট থেকে সিগারেট বের করল। প্যাকেট বাড়িয়ে দিল রবিনসনের দিকে। রবিনসন বিরক্ত মুখে বলল, আমি সিগারেট ছেড়ে দিয়েছি।
ক্যানসারের ভয়ে?
রবিনসন ঠান্ডা গলায় বলল, কেন আজেবাজে কথা বলছ? যা জানতে চাচ্ছি তা বল।
কি জানতে চাচ্ছ? ফকনার সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল, ব্যাপারটা তুমি যতটুকু জান, আমিও ঠিক ততটুকুই জানি। ওয়্যারলেসে কথাবার্তা যা হয়েছে, তুমি শুনেছ। তার পরেও আমাকে জিজ্ঞেস করবার অর্থ কি? এসব হচ্ছে মেয়েলি স্বভাব।