তাঁর সঙ্গী বলল, জ্বিনা স্যার।
আমাকে স্যার বলার দরকার নেই। নাম ধরে ডাকবে। তোমার কি নাম?
জলিল।
হাঁটতে ভালোই লাগছে, কি বল জলিল?
জ্বি স্যার।
রবিনসন হঠাৎ করেই তার নাতি প্রসঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। সে কেমন একা-একা কথা বলে। একদিন দেখা গেল সে একটা কসমস ফুল তুলে এদিক-সেদিক তাকিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছে। তাকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করাতে সে বলেছে, খুব সুন্দর তো, তাই খেতে ইচ্ছা করে। রবিনসন রাস্তা কাঁপিয়ে হাসতে লাগল। তার সঙ্গীও হাসল।
একটিই নাতি আপনার? হ্যাঁ। বড় চমৎকার ছেলে।
ইঞ্জিনের হুম-হুম গর্জন
২৫শে ডিসেম্বর। রাত ৩টা
প্লেন উড়ে চলছে।
ইঞ্জিনের হুম-হুম গর্জন ছাড়া অন্য কোন শব্দ নেই। কেবিন-লাইট জ্বলছে। কমান্ডোদের দেখা যাচ্ছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে থাকতে। প্রথম দিকে তারা নিজেদের মধ্যে মৃদুস্বরে কথাবার্তা বলছিল। এখন আর বলছে না।
সময় যতই ঘনিয়ে আসেছ উত্তেজনা ততই বাড়ছে। সবার চেহারায় তার ছাপ পড়েছে। একমাত্র নির্বিঘ্নে ঘুমুচ্ছে বেন ওয়াটসন। এই একটি লোকের মধ্যেই কোনো রকম বিকার নেই।
কেবিন-লাইটের পাশেই একটি লাল বাতি জ্বলে উঠল, যার মানে, প্লেনের ক্যাপ্টেন কথা বলতে চান। ফকনার হেডফোন কানে পরে নিল।
হ্যালো, ফকনার বলছি।
আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি স্যার।
তাই নাকি?
কুড়ি মিনিটের মাথায় ড্রপিং জোনে চলে আসব। আপনি সবাইকে তৈরি হতে বলুন।
বাইরের আবহাওয়া কেমন?
খুব ভালো বলা চলে না। শক্ত বাতাস বইছে।
ফকনার ভ্রূ কোঁচকাল। ক্যাপ্টেন বলল, আমি কেবিনের বাতি কমিয়ে দিচ্ছি, যাতে চোখে অন্ধকার সয়ে যায়।
ঠিক আছে।
প্লেনের গতি কমে আসছে। নিচে নেমে এসেছে বেশ খানিকটা। দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে। বাইরের প্রচণ্ড বাতাসের ঝাপটায় প্লেন এখন কেঁপেকেঁপে উঠছে। কেবিনের ভেতরটা প্রায় অন্ধকার।
ফকনার গম্ভীর গলায় বলল, অস্ত্ৰ, যন্ত্রপাতি, রসদ এবং প্যারাশুট সবাই পরীক্ষা করে নাও। তোমাদের নিজেদের পরীক্ষা শেষ হলে জনাথন পরীক্ষা করে দেখবে।
বেন ওয়াটসন উঠে বসেছে। সে তাকিয়ে আছে। কেবিনে ঠিক এই মুহূর্তে প্রচণ্ড কৰ্মব্যস্ততা। ফকনার বলল, বাইরে দমকা হাওয়া আছে কাজেই প্যারাশুট খোলার ব্যাপারে খুব সাবধান। মাটির কাছাকাছি না পৌঁছা পর্যন্ত কেউ ফিতা টানবে না, তার আগে ফিতা টানলে বাতাস ভাসিয়ে অনেক দূর নিয়ে যাবে।….
সবার আগে নামবে বেন ওয়াটসন এবং তার দল। তারা নেমে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবে না, দ্রুত চলে যাবে এয়ারপোর্টে।
সবার প্রথমে ঝাঁপ দিল ওয়াটসন। ঠাণ্ডা বাতাস বাইরে। নিচের মাটি দ্রুত কাছে এগিয়ে আসছে। আকাশভর্তি তারা। বেন ওয়াটসনের এক বার মনে হল, প্যারাশুট খোলার ফিতা না টানলে কেমন হয়? এটি একটি পুরোন অনুভূতি। প্যারাশুট নিয়ে লাফিয়ে পড়বার পর প্রায় সবারই এটা হয়। অনেকেই শেষ পর্যন্ত ফিতা খুলতে পারে না।
বেন ওয়াটসন মাটিতে নেমেই ঘড়ি দেখল। তিনটা পঞ্চান—পনের মিনিট লেট। তিনটা চল্লিশের ভেতর সবার মাটিতে পা রাখার কথা।
সে তাকাল আকাশের দিকে। একে-একে নামছে সবাই। সে গুনতে চেষ্টা করল—এক, দুই, তিন, চার পাঁচ…..
চারদিকে অন্ধকার
২৫শে ডিসেম্বর। ভোর ৪টা।
চারদিকে অন্ধকার। সূর্য ওঠার এখন এক ঘন্টা দশ মিনিট দেরি। এয়ারপোর্টে পৌঁছতে লাগবে কুড়ি থেকে পঁচিশ মিনিট। বেন ওয়াটসন তার দল নিয়ে ছুটতে শুরু করল। তিরিশ কিলোমিটার—এমন কোনো দূরের পথ নয়। তারা ছোটার গতি আরো বাড়িয়ে দিল। কারো মুখেই ক্লান্তির কোন ছাপ নেই। কোন শব্দও উঠছে না।
বেন ওয়াটসনের মনে হল, জনাথন এদের ভালোই ট্রেনিং দিয়েছে। এয়ারপোর্টে পৌঁছে বেন ওয়াটসনের বিস্ময়ের সীমা রইল না। একটি পুরোপুরি পরিত্যক্ত জায়গা। একতলা একটি দালানে মজুরশ্রেণীর পাঁচ-ছ জন জড়াজড়ি হয়ে ঘুমুচ্ছে। এছাড়া ত্ৰিসীমানায় কেউ নেই। ঘরের দরজা-জানালা ভাঙা ভাঙা জানালায় হু-হু করে হাওয়া খেলছে।
লোকগুলি ঘুম ভেঙে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। বেন ওয়াটসন জিজ্ঞেস করল, কেউ ইংরেজি জান?
কোনো উত্তর নেই। ওরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।
কেউ ইংরেজি জান না?
ওরা নিজেদের মধ্যে বিড়বিড় করল। এদের দেখে মনে হয় না কেউ ইংরেজি জানে।
কেউ জানে না?
স্যার, আমি জানি।
তুমি কে? আমি স্যার একজন কন্ট্রাক্টর। এই এয়ারপোর্ট ঠিক করার কন্ট্রাক্ট নিয়েছি।
ভালো করেছ। এখানে কোনো পাহারা থাকে না?
জ্বিনা স্যার, পাহারা থাকবে কেন?
তাও তো কথা। রানওয়ে ঠিক আছে?
আছে স্যার। মোটামুটি আছে। আপনারা কারা?
আমরা কারা তা দিয়ে তোমাদের দরকার নেই। তোমরা গরম পানির ব্যবস্থা করতে পারবে?
পারব স্যার। পানির ব্যবস্থা কর। আর শোন, তোমাদের কেউ এখান থেকে পালাবার চেষ্টা করবে না। যদি আমরা বুঝতে পারি তোমাদের কোনো মতলব আছে, তা হলে সঙ্গে-সঙ্গে গুলি করা হবে। আমরা মানুষ ভাল নই।
কতটুকু গরম পানি করব স্যার?
আমার কাছে কফি বিস আছে। সবাই মিলে কফি খাব, কাজেই বুঝতে পারছ কতটুকু পানি লাগবে।
জ্বি স্যার।
পানি গরম হবার পরপর তুমি তোমার লোকজন নিয়ে রানওয়ে পরীক্ষা করতে যাবে। একটা ডেকোটা প্লেন নামবে। ঠিকমতোনামতে পারে যাতে, সে-ব্যবস্থা করবে। তোমাদের কাছে কিছু মালমশলা নিশ্চয়ই আছে।
আছে স্যার। গুড, ভেরি গুড।
বেন ওয়াটসন কফির পেয়ালা হাতে বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল। তার মুখ ভাবলেশহীন। এয়ারপোর্ট দখল করতে তাকে একটি গুলিও খরচ করতে হয় নি, এটা তাকে মোটও প্রভাবিত করে নি। তাকে দেখে মনে হয়, এরকম হবে তা সে জানত।