মাঠের মতো ফাঁকা জায়গায় একটি আর্মি ট্রান্সপোর্ট হেলিকপ্টার দাঁড়িয়ে। হেলিকপ্টারের লেজের দিকে একটা লাল বাতি জ্বলছে-নিভছে। একচক্ষু দৈত্যের মতো লাগছে হেলিকপ্টারটিকে। নিশো হেলিকপ্টারটির কাছে এসে দাঁড়াতেই তার প্রপেলার ঘুরতে শুরু করল। নিশো অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, এই মাঠটিকেই তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন। অবশ্যি স্বপ্নের মাঠ আরো বিশাল ছিল। এবং এরকম অন্ধকার ছিল না। চাপা এক ধরনের আলো ছিল, যা শুধু স্বপ্নদৃশ্যেই দেখা যায়। মার্কটল হাত ধরে জুলিয়াস নিশোকে উঠতে সাহায্য করল। নিশো আন্তরিক ভঙ্গিতেই বললেন, ধন্যবাদ, তুমিও কি যাচ্ছ আমার সঙ্গে?
না, আমি যাচ্ছি না। আপনার উপহার আমি যথাসময়ে মেয়েটিকে পৌঁছে দেব। শুভ যাত্রা।
যাত্ৰা কি সত্যি শুভ?
মাৰ্কটল কোনো উত্তর দিল না কিন্তু জুলিয়াস নিশোকে অবাক করে দিয়ে সামরিক কায়দায় একটি স্যালুট দিল। এক জন নির্বাসিত মানুষকে বিদেশি সেনাবাহিনীর এক জন অফিসার কি স্যালুট করে? করে না বোধহয়। নিশো মাকটলের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লেন।
হেলিকপ্টারের ভেতর নরম আলো জ্বলছে। অন্ধকার থেকে আসার জন্যেই হয়তো এই আলোতেও সব পরিষ্কার চোখে পড়ছে। বেঁটেমতো এক লোক নিশোকে বসবার জায়গা দেখিয়ে দিল। অত্যন্ত ভদ্র ভঙ্গিতে বলল, আপনার কি ঠাণ্ডা লাগছে?
হ্যাঁ, লাগছে। এই কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে নিন। এক্ষুনি গরম কফি দেওয়া হবে। তোমাকে ধন্যবাদ।
আপনি তো মাঝে-মাঝে ধূমপান করেন। এই চুরুটটি টেস্ট করে দেখবেন? হাভানা চুরুট।
তোমাকে আবার ধন্যবাদ।
হেলিকপ্টারের ব্লেড ঘুরতে শুরু করেছে। আকাশে উড়বে। দরজা বন্ধ করা হয়েছে। ককপিটের পাইলট বেতারে নিচু গলায় কী-সব বলছে। নিশোর গা-ঘেঁষে বেঁটে লোকটি দাঁড়িয়ে। নিশো মৃদুস্বরে বললেন, তোমরা কি আমাকে জেনারেল ডোফার হাতে তুলে দিচ্ছ?
হ্যাঁ।
কেন, জানতে পারি?
না, পারেন না। কারণ, আমি জানি না। কারণটি আপনার সরকার এবং জায়ার সরকারের জানার কথা। আমার জানার কথা নয়। আমার দায়িত্ব হচ্ছে আপনাকে ফোর্টনকে পৌঁছে দেওয়া।
জেনারেল ডোফা এখন কোথায় আছেন?
আলজেরিয়াতেই আছেন। দ্বিপাক্ষিক একটি চুক্তির ব্যাপারে তিনি এসেছেন। আজকের খবরের কাগজেই তো আছে। আপনাকে কি খবরের কাগজ দেওয়া হয় না?
না।
আমি আপনাকে খবরের কাগজ দিতে পারি। আমাদের এখানে দি আলজিরিয়া মর্নিং আছে। দেব?
না, দরকার নেই। কিছু জানতে ইচ্ছে করছে না।
জুলিয়াস নিশোকে কফি দেওয়ার পরপরই হেলিকপ্টার আকাশে উড়ল। নিশো কফিতে চুমুক দিয়ে চারদিক দেখতে লাগলেন। ভেতরটা বেশ বড়। তিনি এবং বেটে। লোকটা ছাড়া আরো তিন জন সৈন্য আছে। তারা আটোমেটিক সাব-মেশিনগান হাতে পেছনের দিকে বসে আছে। চোখে চোখ পড়তেই তারা চোখ নামিয়ে নিল।
নিশো ওদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। ষাট বছর বয়সের এক জন অথর্ব বৃদ্ধের জন্যে এত সতর্কতার প্রয়োজন কী? হালকা গলায় বললেন, তোমরা তোমাদের অস্ত্রশস্ত্র নামিয়ে রেখে কফি খাও। আমি পাব না। হেলিকপ্টার থেকে পালাবার কৌশল আমার জানা নেই।
সৈন্য তিন জন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। বেঁটে অফিসারটি বলল, মিঃ জুলিয়াস নিশো, আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে শ্রদ্ধা করি। আমি আপনার এক জন বিশেষ ভক্ত। কিন্তু……..
তিনি হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিয়ে সোহেলি ভাষায় ছোট্ট একটা কবিতা আবৃত্তি করলেন। সঙ্গে-সঙ্গেই তা ইংরেজিতে অনুবাদ করলেন। কবিতাটির ভাবার্থ হচ্ছে —
হৃদয় যখন হৃদয়কে বুঝতে না পারে তখনি ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়।
অফিসারটি অস্বস্তিতে কপালের ঘাম মুছল। নিশো বললেন, তোমার নাম এখন জানা হয় নি। তুমি আমার নাম জান। আমার অধিকার আছে তোমার নাম জানার।
আপনি একজন বিখ্যাত ব্যক্তি। আপনার নাম সবাই জানে। আমি একজন অখ্যাত লেফটেন্যান্ট কর্নেল।
আমি কি এই অখ্যাত লেফটেন্যান্ট কর্নেলের নাম জানতে পারি?
স্যার, আমার নাম পেয়েরেন। হোসেন পেয়েরেন।
পেয়েরেন।
বলুন স্যার।
তুমি কি বলতে পার আমাকে হত্যা করা হবে কি না?
মৃত্যুর কথা একমাত্র ঈশ্বরই বলতে পারেন।
জুলিয়াস নিশো চাপাস্বরে হাসলেন। হাসতে-হাসতে বললেন, ঈশ্বর নিয়ে আমি চিন্তা করি না। আমার চিন্তা মানুষদের নিয়ে।
পেয়েরেন চুপ করে রইল। হেলিকপ্টারের পাইলট একটি সাংকেতিক বার্তা পাঠাল—কালো পাখি তার নীড়ে। এই সংকেতের অর্থ হচ্ছে—সব ঠিকমত এগুচ্ছে।
নিশো চোখ বন্ধ করে ফেললেন। ক্লান্ত গলায় বললেন, বাতি নিভিয়ে দাও। চোখে আলো লাগছে। আমি ঘুমুবার চেষ্টা করব। কে জানে এটাই হয়তো আমার শেষ ঘুম।
বাতি নিভিয়ে দেওয়া হল। ইঞ্জিনের একঘেয়ে হুম্ হুম্ শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। চারদিকে বিপুল অন্ধকার। হেলিকপ্টার উড়ে চলেছে। আফ্রিকার চিরসবুজ অরণ্যের ওপর দিয়ে।
জুলিয়াস নিশে ঘুমুতে চেষ্টা করছেন। কালোসোহেলি আফ্রিকানদের নেতাপ্রবাদপুরুষ জুলিয়াস নিশো। মুকুটহীন সম্রাট।
কিছু কিছু অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ আছে
কিছু কিছু অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ আছে, যাদের বোকার মত দেখায়। জেনারেল ডোফা সেরকম এক মানুষ। বিশালবপু বৃষস্কন্ধ ব্যক্তি। সামনের পাটির দাঁত অনেকখানি বের হয়ে আছে। মুখে দাড়ি-গোঁফের চিহ্নও নেই। নিচের ঠোঁট ঘেঁষে একটি গভীর ক্ষতচিহ্ন নেমে গেছে, যার জন্যে জেনারেল ডোফার মুখ সবসময় হাসি-হাসি মনে হয়।