- বইয়ের নামঃ সম্রাট
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ জ্ঞানকোষ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
জুলিয়াস নিশো
জুলিয়াস নিশো একটি ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখলেন। যেন তিনি বিশাল একটা মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। ফাঁকা মাঠ। চারদিক ধু-ধু করছে। প্রচণ্ড শীত। হিমেল বাতাস বইছে। তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না, খুব অবাক হচ্ছেন। তিনি কোথায় এসে পড়লেন? হঠাৎ দূরে ঝনঝন করে শব্দ হল। তিনি শব্দ লক্ষ করে এগুচ্ছেন। তাঁর একটু ভয়ভয় করছে। তিনি বেশ কবার বললেন, কে ওখানে? কেউ সাড়া দিল না, তবে একজন-কেউ শব্দ করে হেসে উঠল।
কে ওখানে?
সম্রাট নিশো, আপনি এই নগরীতে কী করছেন?
তুমি কে?
আমি কেউ না। আমি আপনার এক জন বন্ধু।
তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?
দেখতে পাচ্ছেন না, কারণ আপনার চোখ বাঁধা।
নিশো লক্ষ করলেন, তাই তো, তাঁর চোখ বাঁধা! তখন তাঁর মনে হল—এটা স্বপ্ন। এটা সত্যি নয়।
সম্রাট জুলিয়াস নিশো।
বল।
আপনি পালিয়ে যান। এক্ষুনি আপনাকে হত্যা করা হবে। ঘাতকরা আসছে। তাদের পায়ের শব্দ কি আপনি পাচ্ছেন না?
পাচ্ছি।
তাহলে পালাচ্ছেন না কেন?
জুলিয়াস নিশো পালাবার চেষ্টা করলেন। পারলেন না। তাঁর পা লোহার শিকলে বাঁধা। পালাবার কোন পথ নেই। জুলিয়াস নিশো স্বপ্নের মধ্যেই চেচিয়ে উঠলেন—আমার পায়ের শিকল কেটে দাও। দয়া করে আমার পায়ের শিকল কেটে দাও। তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। ঘড়ি দেখলেন রাত দুটো দশ। চারদিকে গভীর নিশুতি। ঝিঝির ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।
ঘামে তাঁর শরীর ভিজে গেছে। তৃষ্ণায় বুক শুকিয়ে কাঠ। স্বপ্নের ঘোর তাঁর এখনো কাটে নি। এরকম ভয়াবহ একটি স্বপ্ন হঠাৎ করে কেন দেখলেন? কী কারণ থাকতে পারে? তিনি ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললেন। মনে-মনে বললেন আমার মন বিক্ষিপ্ত এবং খুব সম্ভব আমি কোনো কারণে অসহায় বোধ করছি। সেই কারণেই আমার অবচেতন মন এরকম একটি ভয়াবহ স্বপ্ন আমাকে দেখিয়েছে।
তিনি বিছানা ছেড়ে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালেন। পানি খাওয়া দরকার। পানির তৃষ্ণা হচ্ছে। অথচ জানালার পাশ থেকে সরে আসতে ইচ্ছা করছে না। বাইরে কী চমৎকার তারারা আকাশ! তাঁর স্বপ্নের সঙ্গে এই আকাশের কোনো মিল নেই। জুলিয়াস নিশো আবার একটি নিঃশ্বাস ফেললেন, আর ঠিক তখন দরজায় নক হল, মৃদুনক। যেন কেউ খুব আলতো করে দরজায় হাত রেখেছে।
কে? মিস্টার জুলিয়াস নিশো? হ্যাঁ।
দরজা খুলুন। আপনার সঙ্গে জরুরি কথা আছে। রাত-দুপুরে?
হ্যাঁ। আপনার পরিচয় জানতে পারি? দরজা খুলুন।
তিনি দরজা খুললেন। যে-লোকটিকে তিনি দেখলেন, তার গায়ে সামরিক পোশক। কাঁধের ব্যাজে দুটি আড়াআড়ি বর্শা। জুলিয়াস নিশোলোকটির পদবী ঠিক বুঝতে পারলেন না। জায়ার সেনাবাহিনীর চিহ্ন তিনি এখন ঠিক বুঝতে পারেন না।
আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে আমি অত্যন্ত দুঃখিত। কিন্তু কোনো উপায় নেই। আপনাকে আমার সঙ্গে আসতে হবে।
কোথায়?
আমি জানি না, কোথায়।
জুলিয়াস নিশো ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললেন। রাত আড়াইটায় সেনাবাহিনীর এক জন অফিসার তাঁর মতো এক জন অসুস্থ বৃদ্ধের ঘুম ভাঙিয়ে বলবেআপনাকে আমার সঙ্গে আসতে হবে? এবং তিনি জানতে পারবেন না, কোথায়? জুলিয়াস নিশা হালকা গলায় বললেন, কোথায় যেতে হবে?
আমি জানি না মিঃ নিশো।
জানলেও তুমি বলতে না। তুমি করে বলছি, কিছু মনে করছ না তো?
আমি কিছুই মনে করি নি।
সঙ্গে ব্যবহারিক জিনিসপত্র নেব?
কিছুই নেবার প্রয়োজন নেই, শুধু আপনার ওষুধগুলি নিয়ে নিন।
জুলিয়াস নিশো মৃদু স্বরে বললেন, যে-মেয়েটি আমার দেখাশোনা করে, তার কাছ থেকে বিদায় নিতে চাই। আমার মনে হয় আমি আর ফিরে আসব না। মনে হচ্ছে, এটা ওয়ান ওয়ে জার্নি।
মিঃ নিশো, কারো কাছ থেকে বিদায় নেবার মতো সময় আমাদের নেই।
মেয়েটিকে আমি নিজ কন্যার মতো দেখেছি।
লোকটির মুখের একটি পেশিও বদলাল না। জুলিয়াস নিশো মনে-মনে তার প্রশংসা করলেন। লোকটি ভালো সৈনিক।
আমি যদি ওর জন্যে কোন উপহার রেখে যাই, সেটা কি ওর হাতে পৌঁছবে?
নিশ্চয় পৌঁছবে।
তুমি কথা দিচ্ছ?
হ্যাঁ, কথা দিচ্ছি। যা করবার তাড়াতাড়ি করুন।
তিনি একটি খামে কয়েকটি নোট ভরলেনখামের ওপর গোটাগোটা করে লিখলেন—ক্যারি, যা ছিল, তোমাকে দিয়ে যাচ্ছি। এটাকায় তুমি তোমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে সুইজারল্যান্ড থেকে ঘুরে এসো। আমার বন্দিজীবনের শেষ কটি দিন তোমার ভালবাসায় সুস্থ হয়েছিল। পরম করুণাময় ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।
নোটটি তাঁর পছন্দ হল না। তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না। কাজেই ঈশ্বর শব্দটি ব্যবহার করা ঠিক হয় নি।
অফিসারটি বলল, দেরি হচ্ছে। আমাদের হাতে সময় বেশি নেই।
জুলিয়াস নিশো বললেন, তোমার নাম জানতে পারি?
আমার নাম জানার প্রয়োজন আছে কি? আছে। একটি পশু অন্য একটি পশুকে নাম ধরে ডাকে না। কিন্তু এক জন মানুষ অন্য একটি মানুষকে নাম ধরে ডাকতে চায়।
আমার নাম মার্কটল।
মাৰ্কটল, এই খামটি তুমি মেয়েটিকে দেবে। এখানে কিছু ইউএস ডলার আছে। এবং তুমি আমার হয়ে মেয়েটির সঙ্গে হ্যান্ডশেক করবে। চল, এখন যাওয়া যাক।
আপনি গরম কিছু পরে নিন, বাইরে প্রচণ্ড শীত।
ঘর থেকে বেরিয়ে তাঁদের প্রায় সত্তর গজের মত হাঁটতে হল। কনকনে শীতের বাতাস বইছে। চিল ফেক্টার অনেকখানি নেমে গেছে বোধহয়। কান জমে যাচ্ছে প্রায়। তাঁর কষ্ট হতে লাগল। বয়স হয়েছে। এই বয়সে কষ্ট সহ্য হয় না। বাইরে কোন আলো জ্বলছিল না। চারদিক ঘুঘুটে অন্ধকার। তবু তিনি বুঝতে পারলেন, প্রচুর মিলিটারির আমদানি হয়েছে। মিলিটারি আগেও ছিল, তবে এখন অনেক বেশি। তারা চলাফেরা করছে নিঃশব্দে, তবু টের পাওয়া যাচ্ছে।