তাহলে আমিও অপেক্ষা করি।
না, তুমি খেয়ে নাও।
বৃষ্টি ধরে এসেছিল এগারটার দিকে, আবার মুষলধারে শুরু হল। বারান্দায় বেতের একটা চেয়ারে সবুজ শাড়ি পরা রিমি একা-একা বসে রইল। তৌহিদ একবার এসে বলল, তুমি খাবে না?
রিমি জবাব দিল না। তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। সে খুব চেষ্টা করছে চোখের পানি সামলাতে পারছে না। নিজেকে খুব অপমানিত মনে হচ্ছে। যদিও অপমানিত মনে কার কোনো কারণ নেই। ফরহাদ ভাই ঝড়বৃষ্টির কারণে আসতে পারেন নি এটা তো বোঝাই যাচ্ছে।
তৌহিদ মৃদু গলায় ডাকল, এই রিমি।
কি?
তোমার কাছে উনার ঠিকানা আছে? ঠিকানা থাকলে দাও খোঁজ নিয়ে আসি।
খোঁজ নিতে হবে না। রাতদুপুরে তাকে কোলে করে আনতে হবে না-কি? আসার হলে এম্নি আসবে।
এস তাহলে ভাত খেয়ে নাও।
খাব না। আমার ক্ষিধে মরে গেছে।
একটু কিছু মুখে দাও, এত কষ্ট করে রান্নাবান্না করলে।
রিমি উঠে দাঁড়াল। তার ক্ষিধে মরে গেছে কথাটা সত্যি না, বেশ ক্ষিধে পেয়েছে। সে রান্নাঘরে চলে গেল। ঠান্ডা খাবার রিমি মুখে দিতে পারে না, রাতদুপুরে খাবার গরম করতে বসতে হবে।
জোবেদা খানম ডাকলেন, ও খোকা এদিকে একটু আয়।
তৌহিদ সবেমাত্র সিগারেট ধরিয়েছে। রানো সিগারেট ফেলে দিয়ে মার ঘরে ঢুকল।
এসব কী হচ্ছে খোকা? হচ্ছে কী এসব?
কিসের কথা বলছেন?
বৌমা যে আজ আমাকে খেতে দিল না। চৌদ্দ পদের রান্না হয়েছে ঘরে আর আমি না খেয়ে বসে আছি।
তৌহিদ বিব্রত স্বরে বলল, ভুলে গেছে বোধ হয়…..
ঘরে পোষা পাখি থাকলে লোকে তাকে দানাপানি দেয়, একটা বিড়াল থাকলে মাছের কাঁটাটা খাওয়ায়…।
আমি ভাত নিয়ে আসছি।
তোকে কিছু আনতে হবে না। তুই কাল ভোরে আমাকে ছোটনের বাসায় রেখে আসবি।
তৌহিদ মার ঘর থেকে এল রান্নাঘরে। রিমি একটা প্লেটে খাবার নিয়ে দাঁড়িয়েদাঁড়িয়ে খাচ্ছে। তৌহিদকে দেখেই বলল, চুলা ধরানো আছে, তুমি কি চা খাবে?
দাও এক কাপ। আর ইয়ে শোন, মাকে রাতে খাবার দাও নি?
তাই বুঝি বললেন?
হুঁ।
আমি মাকে আর অনিকে রাত আটটায় একসঙ্গে খাইয়ে দিয়েছি। আজকাল উনার কিছু মনে থাকে না।
একটা প্লেটে করে নাহয় অল্প কিছু ….
আশি বছর বয়সের একজন মানুষ রাতে দুবার যদি খায় অবস্থাটা কী হবে জান? যখন ঘর নোংরা করা শুরু করবেন তখন সেসব কে পরিষ্কার করবে, তুমি?
তৌহিদ আরেকটা সিগারেট ধরাল। আজ সারা দিনে এটা হচ্ছে চার নম্বর সিগারেট। দিনে দুটার বেশি খাবে না এই প্ৰতিজ্ঞা টিকছে না। রিমি কিছু বলছে না। অন্য সময় সিগারেট ধরালেই সে কড়াচোখে তাকায়। আজ তাকাচ্ছে না। আজ তার মনটা ভালো নেই। তৌহিদ সিগারেট হাতে শোবার ঘরে চলে এল। রান্নাঘরের সমস্ত কাজকর্ম শেষ করে রিমি ঘুমুতে এল রাত বারটার দিকে। তখনো বৃষ্টি পড়ছে। ঝুম বর্ষণ। রিমি হালকা গলায় বলল, এখন জেগে আছ?
হুঁ।
আচ্ছা শোন, আমি ঠিক করেছি কক্সবাজার যাব। তুমি আমার দিকে তাকিও না, কাপড় বদলাব।
তৌহিদ মুখ ঘুরিয়ে নিল। রিমি বলল, একটা রাফ হিসেব করে দেখেছি হাজার পাঁচেক টাকা হলে আমরা তিনজন সপ্তাহখানিক থেকে আসতে পারি।
এত টাকা আছে তোমার কাছে?
রিমি তার জবাব না দিয়ে বলল, তুমি স্কুল থেকে দিন দশেকের ছুটি নাও।
সত্যি-সত্যি যাচ্ছি না-কি?
হুঁ।
পাঁচ হাজার টাকা তো অনেক টাকা।
রিমি চুপ করে রইল। তৌহিদ ক্ষীণ স্বরে বলল, গয়না-টয়না বিক্রি কর নি তো?
গয়না আছেইবা কী; বিক্রি করবইবা কী?
তৌহিদ লক্ষ করল রিমি একবারও গয়না বিক্রির কথা অস্বীকার করল না। তার মানে এই রকম কিছুই সে করেছে। বাবার বাড়ি থেকে অল্প যা কিছু গয়না-টয়না পেয়েছিল একে-একে এইভাবেই যাচ্ছে। গয়না বিক্রি করে সমুদ্র দেখার কোনো মানে হয়?
বাতি নিভিয়ে রিমি ঘুমুতে এল। মশারির ভেতরে কিছু মশা রয়ে গেছে। কানের কাছে ভনভন করছে। রিমির খুব ক্লান্তি লাগছে। আবার উঠে বাতি জ্বালিয়ে মশা মারতে ইচ্ছে করছে না। ভনভন করতে থাকুক।
তৌহিদ বলল, ঘুমিয়ে পড়লে না-কি?
রিমি বলল, না। তোমার আর কিছু লাগবে? এই ইঙ্গিতটা অন্য ধরনের। এর মধ্যে ভালবাসা নেই। তৌহিদ বলল, না কিছু লাগবে না।
রিমি সহজ স্বরে বলল, এত রাত পর্যন্ত জেগে আছ তাই জিজ্ঞেস করলাম। আমাকে যখন প্রয়োজন হয় তখনি তুমি জেগে থাক। এই জন্যেই এই কথা বললাম। তুমি আবার রাগ-টাগ করে বস না।
তৌহিদ কিছু বলল না।
রিমি আগের মতো স্বরে বলল, ঘরের কাজকর্ম সেরে যখন ঘুমুতে আসি তখন দেখি তুমি আরাম করে ঘুমুচ্ছ। যেদিন দেখি জেগে আছ তখন বুঝি…..
রিমি কথা শেষ করল না। তৌহিদ বলল, রিমি ঘুমুও।
ঘুম এলে ঘুমুব। ঘুমের জন্যে আমাকে সাধাসাধি করতে হবে না।
আজ বোধহয় তোমার মনটা খারাপ।
মন থাকলে তো মন খারাপ হবে। আমার মনই নেই।
ঝগড়া করার চেষ্টা করছ বলে মনে হচ্ছে।
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে বিশ্বাস থাকতে হয়। যখন বিশ্বাস থাকে না তখন আর সেই সম্পর্কও থাকে না।
তৌহিদ বিস্মিত হয়ে বলল, বিশ্বাসের কী অভাব তুমি দেখলে?
তোমার মা বলল, তাকে খাবার দেয়া হয় নি; ওমি তুমি তা বিশ্বাস করে ফেললে।
আমি তা করি নি রিমি।
না করলে কেন আমাকে জিজ্ঞেস করতে এলে?
ভেবেছিলাম রান্নাবান্না, দাওয়াত এইসব নিয়ে তুমি ব্যস্ত ছিলে; ভুলে গেছ।
রিমি কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। তৌহিদ বলল, ঐ ভদ্রলোক কে?
কোন ভদ্রলোক?
যাকে তুমি খেতে বলেছ?
আমি কাউকে খেতে বলি নি। উনি নিজ থেকে আসতে চেয়েছেন। কেউ আসতে চাইলে আমি তাকে বলব আসবেন না?