রিমি গা ধুয়ে সবুজ রঙের একটা সুতির শাড়ি পরল। এটা তার পছন্দের শাড়ি। কোনো এক বিচিত্র কারণে এই রঙটাই তাকে মানায়। শুধু মানায় না-খুব বেশি রকম মানায়। এই শাড়ি নিয়ে কত কাণ্ড। বছর তিনেক আগে মেজো দুলাভাই তাকে সবুজ সিকের একটা শাড়ি দিলেন। সেই শাড়ি পরে তার পরদিনই সে মেজো দুলাভাইয়ের বাড়ি বেড়াতে গেল। নতুন শাড়ি পড়ে মেজো দুলাভাইকে আর আপাকে সালাম করবে।
দেখা গেল শাড়ি উপহার দেবার কথা রিমির মেজো বোন রূপা কিছুই জানে না। তার মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। রিমির দুলাভাই নাসিম সাহেব আমতা-আমতা করে বললেন, রিমি তার জন্মদিন উপলক্ষে আমার কাছে একটা শাড়ি চেয়েছিল—তাই দিলাম আর কি।
রিমি অবাক হয়ে বলল, আমি আবার আপনার কাছে কখন শাড়ি চাইলাম।
নাসিম সাহেব শুকনো গলায় বললেন, গত বছর চেয়েছিলে। তোমার মনে নেই।
রূপা খড়খড়ে গলায় বলল, ওর মনে নেই আর তুমি মনে করে বসে আছ? তোমার স্মৃতিশক্তি যে এত ভালো তা তো জানতাম না!
খুবই বিশ্রী অবস্থা। রূপা রিমিকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল, ও কি তোমাদের বাসায় প্রায়ই যায়?
রিমি বলল, না তো।
তোর মুখ দেখেই মনে হল তুই মিথ্যা কথা বলছিস। ও যায় প্রায়ই।
ছিঃ আপা!
আমাকে ছিঃ আপা করতে হবে না। আমি কচি খুকী না। আট বছর বিয়ে হয়েছে—আমাকে একদিন একটা শাড়ি কিনে দেয় নি, আর তোকে ঘরে গিয়ে শাড়ি দিয়ে এল?
রিমি ঐ শাড়ি আর পরে নি। ফেলে দিতে ইচ্ছে করছিল, ফেলতেও পারে নি। ন্যাপথলিন দিয়ে ট্রাংকের একেবারে নিচের দিকে রেখে দিয়েছে। কে জানে, হয়ত এর মধ্যে তেলাপোকায় কেটে দিয়েছে। কাটুক। কেটে ফেললে এই শাড়ি কাউকে দেয়া সহজ হবে।
সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখল। ভালোই তো দেখাচ্ছে। গলায় যদি শুধু সবুজ পাথর বসানো হার থাকত। চোখে একটু কাজল কি দেবে? ক্ষতি কি? রিমি। আড়চোখে পাশের খাটে শুয়ে-থাকা তৌহিদের দিকে তাকাল। তৌহিদ ঘুমুচ্ছে। ছুটির দিনে দুপুরবেলায় সে ঘুমুয়। ঘুম ভাঙে সন্ধ্যার আগে-আগে। আজো তাই করবে। করুক। রিমি চোখে কাজল দিল। আয়নায় নিজেকে দেখে এখন কেন জানি লজ্জালজ্জা করছে। লজ্জার কিছুই নেই। বাইরের একজন মানুষ আসবে—সেই উপলক্ষে একটু সাজগোজ করলে ক্ষতি কি? তার দামি পারফিউম নেই, পাউডার নেই। সামান্য একটু কাজল।
রিমি বারান্দায় এসে দাঁড়াল। জিতু মিয়াকে ভেজা ন্যাড়া দিয়ে বারান্দা মুছতে বলে গিয়েছিল। সে তা না করে অনির সঙ্গে খেলছে। অনি কাগজে ছবি আঁকছে, জিতু মুগ্ধ চোখে তাই দেখছে।
অনি মাকে দেখেই মুগ্ধ গলায় বলল, মা তোমাকে অন্য বাড়ির বৌয়ের মতো লাগছে। জিতুও তাকিয়ে আছে। তার চোখেও মুগ্ধ বিস্ময়।
জোবেদা খানম তাঁর ঘর থেকে ডাকলেন, ও বৌমা, বৌমা। একটু শুনে যাও তো।
নিতান্ত অনিচ্ছায় রিমি শাশুড়ির ঘরে ঢুকল।
আজ সারাদিনে তোমার দেখা পেলাম না। ব্যাপার কি মা?
ব্যাপার কিছুই না।
ভালোভালো জিনিস রান্না হচ্ছে। ঘ্রাণ পাচ্ছি। কেউ আসবে?
হ্যাঁ।
সেটা আমাকে বলতে অসুবিধা কি? তোমার বাপের বাড়ির দিকের কেউ? বাপের বাড়ির দিকের কারোর আসার কথা থাকলে রান্নাবান্নার ধুম পড়ে যায়। শ্বশুরবাড়ির দিকের কেউ আসলে ঠন-ঠনা-ঠন—বেগুন ভর্তা, ডাল চচ্চড়ি।
এইটা বলার জন্যেই ডেকেছেন, না আরো কিছু বলবেন?
ছাদে কাপড় থাকলে নামিয়ে আন মাঝড়বৃষ্টি হবে। ঐ দেখ পিঁপড়া মুখে ডিম নিয়ে যাচ্ছে। যখন দেখবে পিঁপড়া মুখে ডিম নিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাচ্ছে, তখন বুঝবে ঝড়বৃষ্টি হবে।
আপনি তো চোখেই দেখেন না। পিঁপড়ার মুখের ডিমও দেখে ফেললেন।
চোখে দেখি না তোমাকে কে বলল মা? রোজ যে কোরান শরীফ পড়ি শুনতে পাও না? গান-বাজনা তো সবই কানে ঢোকে। আল্লাহর পাক কালাম ঢোকে না? তুমি বাড়ির বৌ-নামাজ পড়বে। রোজা রাখবে। দুপাতা কোরান পড়বে। তা না–দিনরাত সাজসজ্জা।
সাজসজ্জার আপনি কি দেখলেন?
সবই তো দেখছি না। অন্ধ তো না। চোখ খোলা, কানও ভোলা। চারপাশে যা ঘটে সবই দেখি। সবই শুনি।
ভালো। আল্লাহ আপনার চোখ আরো ভালো করুক। কানও ভালো করুক।
রিমি ঘর ছেড়ে আবার বারান্দায় এল। জিতু মিয়া বারান্দা মোছা শুরু করেছে। ওকে দিয়ে বাড়িওয়ালার বাগান থেকে কয়েকটা গোলাপ এনে ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখলে কেমন হয়? চাইলে দেবে কিনা কে জানে। কেউ ফুলে হাত দিলে খ্যাক করে ওঠে।
জিতু মিয়া।
জ্বি আম্মা?
বারান্দার কাজ শেষ হলে তুই বাড়িওয়ালার বাসায় যাবি, উনার বড় মেয়েকে আমার কথা বলে বলবি কয়েকটা গোলাপ ফুল দিতে। আচ্ছা থাক, তোর যেতে হবে না। আমিই যাব। শুধু ফুল আনলে হবে না। একটা টেবিল ক্লথ আনতে হবে। পানির ভালো জগ নেই। ওদের বাসায় একটা ক্রিস্টালের জগ আছে। রিমির নিজেরই যাওয়া দরকার।
জোবেদা খানম পিঁপড়াকে মুখে ডিম নিয়ে যেতে দেখেছেন কি-না কে জানে; তবে সন্ধ্যা মেলাবার আগেই আকাশ অন্ধকার করে ঝড়বৃষ্টি শুরু হল। ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। হাওয়ার শোঁ-শোঁ গর্জন। দেখতে দেখতে গলির মোড়ে এক হাঁটু পানি জমে গেল। বাসার সামনের আমগাছের একটা ডাল ভাল বিকট শব্দে। অনি ভয় পেয়ে কাঁদতে লাগল।
নিমন্ত্ৰিত অতিথির আসবার প্রশ্নই ওঠে না। তবু রিমির মনে হল ফরহাদ ভাই আসবেন। যত রাতই হোক আসবেন। না এসে পারবেন না। তাঁকে আসতেই হবে।
তৌহিদ ক্ষিধে সহ্য করতে পারে না। সে দশটার সময় খেতে বসল। রিমি লাজুক গলায় বলল, আমি একটু অপেক্ষা করি। বৃষ্টি তত কমে এসেছে। এখন যদি আসেন।