রিমি এক ঝলক তাকিয়েই নিজের মনে কাজ করতে লাগল। তৌহিদ বেতের মোড়ায় বসতে-বসতে বলল, চা হবে?
তোমার ছাত্র গেছে?
না যায় নি। চলে যাবে। ব্যাটা আজ আমার মেজাজটা খারাপ করে দিয়েছে।
কেতলিতে পানি গরমই ছিল। রিমি কাপে ঢালতে-ঢালতে বলল, আজ রাতে একজনের দাওয়াত আছে—সে খাবে। তুমি সন্ধ্যার পর কোথাও বেরুবে না।
তৌহিদ বিস্মিত হয়ে বলল,আমি তো সন্ধ্যার পর সব সময় ঘরেই থাকি।
বলে রাখলাম আর কি।
কে আসবে?
তুমি চিনবে না। ফরহাদ ভাই। আমাদের ময়মনসিংহের বাসার সামনের বাসায় থাকতেন। ঐ দিন হঠাৎ এসে উপস্থিত। আমি প্রথমে চিনতেই পানি নি। উনি নিজ থেকেই বললেন শুক্রবারে তোমাদের এখানে খাব। আমি তো আর বলতে পারি না–না।
তা বলবে কেন? দাওয়াত দিয়ে ভালোই করেছ। বাইরের কেউ এলে সেই উপলক্ষে ভালো-মন্দ খাওয়া হবে। অনেক দিন ভালো কিছু খাওয়া হয় না।
ভালো কিছু করব কোত্থেকে? টাকাপয়সার যা অবস্থা।
আমার কাছে কিছু আছে। মজিদ ধার নিয়েছিল—কাল কী মনে করে দিয়ে দিল। ও তো আবার ধার নিলে ফেরত দিতে ভুলে যায়।
কত টাকা?
পাঁচ শ নিয়েছিল। তিন শ ফেরত দিয়েছে। পুরোটাই আছে। আমি খরচ করি নি।
একজন চাইতেই তুমি পাঁচশ টাকা দিয়ে দিলে? আশ্চর্য!
খাতা দেখার টাকা পেয়েছিলাম। চাইল, না করতে পারলাম না।
আগে নিজে চলবে; তারপর তা অন্যকে ধার দেবে। ধার দাও ভালো কথা, আমাকে বলবে না?
রিমির চোখ-মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। সে নিচু গলায় বলল, প্রতিটা টাকা আমি হিসাব করে খরচ করি। তুমি কিছুই বুঝতে চাও না। বাড়িভাড়া পাঁচশ টাকা বাড়িয়েছেঐ নিয়েও কিছু বললে না। এক কথায় রাজি হয়ে এলে।
রাজি হই নি তো। চুপচাপ ছিলাম। কিছুই বলি নি।
চুপচাপ থাকাই তো রাজি হওয়া। স্কুল মাস্টারি করে-করে তোমার স্বভাব হয়েছে মিনমিনে। এই যুগে শক্ত না হলে চলে?
তা ঠিক।
স্কুল মাস্টাররাও তো আজকাল ভালো আছে। সাতটা-আটটা টিউশানি করে। দুতিন ব্যাচ করে পড়ায়। ওদের বাসায় ফ্রিজ-টেলিভিশন সবই আছে। শুধু তোমারই কিছু নেই। একটা ভালো নাটক হলে বাড়িওয়ালার বাসায় যেতে হয়।
একটা টেলিভিশন এই বছর কিনে ফেলব।
চট করে বলে ফেললে কিনে ফেলব। কোত্থেকে কিবে? আকাশ থেকে টাকার বৃষ্টি হবে?
আজ তোমার মন মনে হয় বেশি খারাপ। ডাক্তার আমাকে কী বলেছে জান? ডাক্তার বলেছে যেদিন তোমার সঙ্গে আমার ঝগড়া হয় সেদিনই শ্বাসকষ্টটা হয়। এটা আমার এক ধরনের মানসিক ব্যাধি।
অন্য কোনো ডাক্তারকে দেখাও। ঐ গাধা ডাক্তারকে দেখিয়ে লাভ নেই। গত মাসে তোমার যে শ্বাসকষ্ট হল ঐদিন কি তোমার সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়েছিল। চিড়িয়াখানায় গেলাম। ফিরে আসার পরপর….মনে নেই?
আছে, মনে আছে।
তৌহিদ চা শেষ করে উঠে পড়ল। মনিরের খোঁজ নিতে হয়। গাধাটা এখনো বসে কলম কামড়াচ্ছে না চলে গেছে কে জানে।
মনির যায় নি। সে হাসিমুখেই বসে আছে। তৌহিদ ঘরে ঢোকামাত্র বলল, অঙ্কটা মিলেছে স্যার। রেজাল্ট মিলিয়ে দেখছি। এইটা ছাড়াও আরো দুটা করে ফেলেছি।
তৌহিদ দেখল—অঙ্কগুলো হয়েছে।
হয় নাই স্যার?
হয়েছে। গুড।
আপনার কী মনে হয় স্যার? অঙ্কে পাস করব?
করবে। রাগের মাথায় এইসব বলি। রাগের কথা কখনো ধরতে নেই।
আমি স্যার ধরি না। বকা দিলে মনটা খারাপ হয়। সব জায়গায় বকা খাই। বাসায় বকা, বাইরে বকা। আমার স্যার কপালটা খারাপ।
তৌহিদের মন খারাপ হয়ে গেল। এই ছেলেটাকে বকাঝকা করা উচিত হয় নি। আসলে টিচার হবার যোগ্যতাটা তার নেই। একজন টিচার কখনো ছাত্রদের ওপর রাগবেন না। বিন্দুমাত্র বিরক্ত না হয়ে একটা বিষয় দশবার বুঝবেন। তারপরও যদি ছাত্র বুঝতে না পারে সে ব্যর্থতা শিক্ষকের, ছাত্রের না।
স্যার আজ তাহলে যাই?
চল। আমিও তোমার সঙ্গে বেরুব। সিগারেট কিনব।
আগামী সপ্তায় আমি কি স্যার আসব না?
আসবে না কেন?
ম্যাডাম বলছিলেন, আপনারা কক্সবাজার যাচ্ছেন।
তাই নাকি? আমাকে তো কিছু বলে নি!
তৌহিদ খুবই বিস্মিত হল। রিমির স্বভাবের সঙ্গে সে পরিচিত। সে জানে রিমি ভেতরে কাজকর্ম অনেকদূর এগিয়ে একদিন হুট করে….এবারও তাই করছে। টাকাপয়সা কোত্থেকে জোগাড় করছে কে জানে। গয়না-টয়না বিক্রি করে দেয় নি তো? তার গয়না বিক্রির অভ্যাসও আছে। প্রয়োজনেই করে। গয়না বিক্রির পর কয়েকটা দিন খুব বিষণ্ণ থাকে। বেচারী। দরিদ্র শিক্ষকের ঘরে এসে খুব কষ্ট করল। সেই তুলনায় তার অন্য দুবোন রাজরানীর মতো আছে। তারাও ঢাকা শহরেই থাকে। নিজেদের বাড়িতে। দুজনেরই গাড়ি আছে। এই তিন বোনের মধ্যে রিমিই সবচে সুন্দরী। এখনো রিমির দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকাতে হয়। অথচ এই রিমিরই সবচে খারাপ বিয়ে হল। কোনো মানে হয় না।
তৌহিদ ফুটপাতে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। মাঝে-মাঝে তাকাচ্ছে আকাশের দিকে। মার্চ মাসের ঝকঝকে নীল আকাশ। এই নীল আকাশের ছায়া পড়বে সমুদ্রে। সমুদ্র এখন ঘন নীল। শ্রাবণ মাসে আকাশ যখন ঘন কালো রঙ নিয়ে নেবে তখন সমুদ্রও হবে কালো। আকাশ এবং সমুদ্র সব সময় একে অন্যের হাত ধরে চলে। তৌহিদের মনে হল, এদের দুজনের খুব মিল আছে। পৃথিবীর মানুষ জমি ভাগাভাগি করে নিয়ে নিয়েছে কিন্তু সমুদ্র এবং আকাশ এই দুটি নিতে পারে নি। কোনোদিন পারবে না।
বিকেল পাঁচটার মধ্যে রিমির রান্নাবান্না শেষ হয়ে গেল। অনেক কিছু করার ইচ্ছে ছিল করতে পারে নি। জিনিসপত্রের যা দাম। অল্প কয়েকটা পদ করতে গিয়েই সাড়ে তিন শ টাকার মতো খরচ হয়ে গেল। ঘরে আলো প্লেট ছিল না। দুটো প্লেট কিনতে লাগল চার শ। প্লেটের খরচও তো আজকের দাওয়াতের মধ্যে ধরতে হবে। রান্না কেমন হয়েছে কে জানে। ভালোই হবে। তার রান্না খারাপ না। পোলাওটা নিয়ে শুধু দুশ্চিন্তা। তার পোলাও কখনো ঠিক হয় না। হয় চাল থাকে, নয়ত নরম হয়ে যায়। পোলাও এখনো চড়ানো হয় নি। মেহমান এলে চড়ানো হবে।