না।
তোমার দেখতে ইচ্ছে করে না?
না।
আমার খুব করে। কেন করে সেই কারণটি একদিন তোমাকে বলব।
আজই বল।
আজ থাক। ঘুম পাচ্ছে। আরেকদিন বলব।
ফরহাদের কথাটা তৌহিদকে বলা দরকার। কীভাবে বলবে তা রিমি ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারছে না। এই গল্পটি কি তাকে বলা ঠিক হবে? সব কিছু কি সবাইকে বলা যায়? বলা উচিত? না থাক, কিছু বলার দরকার নেই।
রিমি খুব সহজেই ঘুমিয়ে পড়তে পারে। আজ ঘুমুতে পারল না। প্রায় সারা রাত জেগে কাটাল। কয়েকবার উঠে বারান্দায় পায়চারি করল। মাথায় পানি দিয়ে এল। কিছুতেই কিছু হল না। তার চোখ নিষ্ঠুম। মাঝেমাঝে এমন নিষ্ঠুম রাত তার আসে। তখন খুব খারাপ লাগে, রাত পার করে দিতে হয় বারান্দায় হেঁটে-হেঁটে। এই বাড়ির বারান্দাটা চমৎকার, হাঁটতে ভালো লাগে। ভালো লাগলেও বেশিদিন হাঁটা যাবে না। বাড়ি ছাড়তে হবে। পাঁচ শ টাকা বেশি দিয়ে এই বাড়িতে কে থাকবে? তাদের কি টাকার গাছ আছে? না, তাদের কোনো টাকার গাছ নেই। প্রতিটি টাকা তাদের খুব সাবধানে খরচ করতে হয়।
তৌহিদ সমুদ্র দেখার কথা বলেছে এটাতো কিছুই না। এত কাছে সমুদ্র। তবু এখন মনে হচ্ছে এটা বিরাট একটা কিছু।
জোবেদা খানম তাঁর ঘর থেকে চেচালেন, কে হাঁটে বারান্দায়? কে?
আমি।
তুমি নাকি? বারান্দায় হাঁট কেন?
এম্নি হাঁটি।
অনির জ্বর নাই তো?
না।
তাহলে অনিকে আমার এখানে দিয়ে যাও।
ওকে এখন আনতে পারব না মা। বাবার সঙ্গে ঘুমুচ্ছে।
একা-একা থাকি, একজন কেউ পাশে থাকলে ভালো লাগে।
অনিতো সব সময়ই আপনার সঙ্গে ঘুমায়। একাত না ঘুমুলে কিছু হবে না মা। ওর বাবার কাছ থেকে এখন আনতে পারব না।
জোবেদা খানম খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তোমার কাছে যে লোকটা এসেছিল, সে কে?
কেউ না। আপনি ঘুমান তো। আপনার সব কিছু জানতে হবে না-কি?
এক সংসারে থাকি, কোথায় কী হচ্ছে জানব না? আমি তো একটা মানুষ। কোলবালিশ তো না। কোলবালিশ হলে চুপ করে থাকতাম। আল্লাহতালা আমাকে কোলবালিশ বানান নি। বানালেও কিছু করার ছিল না…
রিমি দরজার সামনে থেকে সরে এল। এইসব কথা শোনার কোনো অর্থ হয় না। এক-এক দিন এত বিরক্ত লাগে যে কাঁদতে ইচ্ছে করে।
বৌমা কি চলে গেলে না-কি? ও বৌমা….
জোবেদা খানম কোনো জবাব পেলেন না।
একটা সময় ছিল যখন কথার জবাব পাওয়া না গেলে মাথায় রক্ত উঠে যেত। এখন আর ওঠে না। জবাব না পাওয়াটাকেই স্বাভাবিক মনে হয়। একটা বয়সের পর মানুষ আর মানুষ থাকে না। কোলবালিশ হয়ে যায়। তিনি তাই হয়েছেন। এবং আশ্চর্য, এই জন্যে তাঁর খুব খারাপ লাগছে না। এই যে রিমি ফটফট করে বেড়াচ্ছে—সেও একদিন কোলবালিশ হবে। শুরুতে আরও খারাপ লাগবে; তারপর আর লাগবে না।
শুক্রবারে তৌহিদের কাছে কোনো ছাত্র পড়তে আসে না। আজ একজন এসে হাজির—মুনির। তৌহিদ কিছু বলবার আগেই মুনির বলল, গত সপ্তাহে দুদিন কামাই হয়েছে স্যার। তৌহিদের ইচ্ছা করছে ঠাস করে মুনিরের গালে একটা চড় বসিয়ে দিতে। তা না করে সে শান্ত গলায় বলল, আজ থাক।
কয়েকটা এক্সট্রা যদি দেখিয়ে দেন ভালো হয়।
অন্যদিন দেখাব। আজ না। আজ আমার শরীরটা ভালো না।
মুনির ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে রইল। মনে হচ্ছে ধাক্কা দিয়ে বের না করলে সে যাবে না। তৌহিদ ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বস দেখিয়ে দেই।
তৌহিদ পাঁচটা এক্সট্রা দ্রুত করে দিল। মুনির কিছু বুঝতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না। আসল উপপাদ্য যে জানে নাসে এইসব কঠিন এক্সট্টার কী বুঝবে? গাধা মার্কা ছেলে। একটা বুদ্ধিমান ছাত্র পাওয়া গেলে ভালো হত। পড়িয়ে আনন্দ। এইসব গরুগাধার পেছনে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।
মুনির বুঝতে পারছ তো?
পারছি স্যার। পানির মতো ক্লিয়ার।
ক্লিয়ার হলেই ভালো।
স্যার এই অঙ্কটা একটু দেখিয়ে দেন। এইটা কীভাবে করব স্যার? ঐকিক নিয়মে?
তৌহিদ শীতল গলায় বলল, তুমি অঙ্কে পাস করতে পারবে না। শুধু-শুধু পরিশ্রম করছ। সাধারণ অঙ্ক কোন নিয়মে করবে তাই যদি না জান…
মনির চোখ-মুখ শক্ত করে বসে রইল। তৌহিদ বলল, বিদ্যা যদি কোনো তরল পদার্থ হত তাহলে চামচে করে খাইয়ে দিতাম। বিদ্যা তরল পদার্থ না, বুঝলে?
মুনির কিছু বলছে না। তৌহিদ অঙ্কটা করল। সেই সঙ্গে এই নিয়মের আরো দুটো করে দেখাল। বই খুলে আরেকটা অঙ্ক বের করে বলল, এটা করতো, দেখি পার কিনা।
আজ থাক স্যার।
থাকবে কেন? কর।
দশটার সময় আমাকে স্যার আরেকজন চিটারের কাছে যেতে হবে। হরিবাবু, ইংরেজি পড়ান।
হরিবাবুর কাছে খানিকক্ষণ পরে গেলেও কোনো ক্ষতি নেই। অঙ্কটা শেষ করে তারপর যাও।
মনির খাতা খুলে অঙ্ক টুকতে-টুকতে বলল, একটু টাইম লাগবে স্যার।
অসুবিধা নেই। তুমি অঙ্ক করতে থাক, আমি ভেতর থেকে আসি।
রিমি রান্নাঘরে।
তৌহিদ রান্নাঘরে ঢুকল। ছুটির দিনে সে রিমির সঙ্গে রান্নাঘরে কিছুটা সময় কাটায়। চুপচাপ বসে থাকে। রিমি রান্নাঘরের কাজকর্ম সারে। মাঝে-মাঝে বিরক্ত গলায় বলে, কি বিশ্রী স্বভাব। রান্নাঘরে বসে আছ কেন?
তোমার তো কোনো অসুবিধা করছি না।
ধুঁয়ার মধ্যে শুধু-শুধু বসে থাকা। চা খাবে?
খাব।
শোন-চা খাওয়াটাও কমাও। মিনিটে-মিনিটে চা।
আচ্ছা কমাব।
তৌহিদ লক্ষ করেছে রান্নাঘরের সময়টায় রিমি রেগে-রেগে অনেক কথা বললেও মনে-মনে বেশ খুশি হয়। এই খুশি ভাবটা সে চেপে রাখতে পারে না।
আজ রিমি বেশ গম্ভীর। তৌহিদকে ঢুকতে দেখেও অন্যদিনের মতো বলল না, আবার রান্নাঘরে ঢুকলে?