ডাক্তার বলল, বসুন।
তারপর?
তারপর আমি বসলাম।
তারপর?
আমি বললাম, স্লামালিকুম।
তৌহিদ টের পাচ্ছে রিমি রেগে যাচ্ছে। রিমি আগ্রহ নিয়ে বসে আছে সব কিছু শুনবে-তৌহিদ গুছিয়ে বলতে পারছে না। এই লোক ক্লাসে পড়ায় কী করে কে জানে?
তারপর কি হল বল। ডাক্তার সাহেব নিশ্চয়ই জানতে চাইলেন তোমার অসুখটা কি, তাই না?
হুঁ।
তুমি বললে?
তৌহিদ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, অনির জ্বর কমেছে?
হ্যাঁ কমেছে। তুমি তোমার কথা বল। তুমি কি বললে?
আমার এখন আর কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। অন্য সময় বলব।
তৌহিদ উঠে দাঁড়াল। সে এখন হাত ধুয়ে ফেলবে। তার প্লেটে এখনো অনেক। ভাত। সে ক্ষিধে আন্দাজ করতে পারে না। শিশুদের মতো স্বভাব। প্লেট ভর্তি ভাত রেখে সে উঠে পড়ে। প্রতিদিন ভাত নষ্ট করে। রিমির কষ্ট হয়।
বেসিনে হাত ধুতে-ধুতে তৌহিদ বলল, মেয়েটার হঠাৎ জ্বর এল কেন? রিমি মুখ শক্ত করে বসে রইল। তৌহিদের কথার জবাব দিতে ইচ্ছে করছেনা। তৌহিদ তার কথার জবাব ঠিক মত দিচ্ছে না, সে কেন দেবে? তার এত কী দায় পড়েছে? তৌহিদ হাত ধুতে-ধুতে বলল, মেয়েটাকে একটা ভালো ডাক্তার দেখানো দরকার। প্রায়ই জ্বরজ্বারি হয় এটা ভালো কথা না।
রিমি একটা কথার জবাব দিল না। আশ্চর্যের ব্যাপার, এতে লোকটা দুঃখিত হল না। সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘর থেকে বের হল। জিতুকে বলল, একটা পান দে।
রিমির চট করে মনে পড়ল—ঘরে পান নেই। জিতুকে আনতে বলা হয়েছিল জিতু আনে নি। রিমি জানে তৌহিদের সঙ্গে রিমির কী কথা হবে। রিমি এই মানুষটাকে বাচ্চাদের বাংলা কোনো বইয়ের মধ্যে পড়ে ফেলতে পারে। দাঁড়ি-কমাসুদ্ধ বলতে পারে, একটুও এদিক-ওদিক হয় না। জিতু বলবে-ঘরে পান নেই। লোকটা বলবে-আচ্ছা ঠিক আছে।
হলও তাই। জিতু বলল, পান আনতে ভুলে গেছে। তৌহিদ বলল, ঠিক আছে। লাগবে না। ছাত্ররা এসেছিল?
হুঁ। বলছি আজ পড়া হইত না। স্যারের শইল খারাপ।
আচ্ছা, ঠিক আছে।
রিমির রাগ দ্রুত বাড়ছে। সব কিছুতেই আচ্ছা ঠিক আছে কেন? নিজের কোনো ইচ্ছা-অনিচ্ছা নেই? যে যা বলবে তাতেই আচ্ছা ঠিক আছে। বাড়িওয়ালা ঐদিন ডেকে নিয়ে এক ধাক্কায় পাঁচ শ টাকা বাড়ি ভাড়া বাড়িয়ে দিল। পানির ট্যাক্স বেড়েছে, ইলেকট্রিসিটির চার্জ বেড়েছে, হেনতেন কত কথা। লোকটা সবকিছু শুনে বলল,আচ্ছা, ঠিক আছে।
ঠিক থাকবে কীভাবে? এর মধ্যে ঠিক থাকার কী আছে? মুখের একটা কথাতেই বাড়ি ভাড়া পাঁচ শ টাকা বেড়ে যাবে? টাকা এত সস্তা? পাঁচ শ টাকা বেশি দিয়ে তারা এ বাড়িতে থাকবে কেন? ঢাকা শহরে বাড়ি কম পড়েছে?
অনি আজ বাবা-মার সঙ্গে শুয়েছে। রিমিদের খাটটা প্ৰকাণ্ড। বিয়ের সময় রিমির বাবা। মেয়েকে যেসব ফার্নিচার দেবেন বলে কথা দিয়েছিলেন তার মধ্যে খাট ছিল, ড্রেসিং টেবিল ছিল, সোফা ছিল। দেবার সময় দিয়েছে প্রকাণ্ড একটা খাট। আর কিছু না। ঐ খাট পেয়েই তৌহিদ খুশি। বিয়ের রাতেই কম করে হলেও তিনবার বলল, বাহু সুন্দর খাট তো! শুরুতে রিমির মনে হচ্ছিল ঠাট্টা করা হচ্ছে। সে লজ্জায় মরে যাচ্ছিল। তৌহিদের ছোট বোন খুব ক্যাটক্যাট করে কথা বলতে পারে সে কঠিন-কঠিন কথা শুনাচ্ছে—যা যা দেবার ছিল কিছুই দেয় নি—একটা ফুটবল মাঠে স্ট্যান্ড লাগিয়ে দিয়ে দিয়েছে। এর নাম নাকি খাট।
রিমির নিজেরও তার বাবার উপর খুব রাগ হয়েছিল। তার বাবা তাকে ঠকিয়েছে। অন্য বোনের বেলায় যেমন খরচপাতি করেছিলেন তার কিছু করেন নি। সব কিছু দায়সারা। ছেলেকে কাপড়চোপড় কেনার জন্যে দশ হাজার টাকা দেওয়ার কথা ছিল; ঐ টাকাটা পর্যন্ত দেন নি। তৌহিদ কোনো দিন এ নিয়ে কোনো কথা বলে নি।
রিমি জিতুকে দোকানে পাঠিয়ে পান আনাল এবং একটা সিগারেটও আনাল। শোবার ঠিক আগে-আগে পান এবং সিগারেট পেলে মানুষটা নিশ্চয়ই খুশি হবে। সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো কি এই মানুষটা মনে রাখে? তাকে খুশি করার এই ধরনের চেষ্টা যে রিমির মনে আছে তা কি এই মানুষটা টের পায়। সম্ভবত না। এক শ্রেণীর পাথর টাইপ মানুষ আছে জগৎ-সংসারের কোন কিছু যাদের স্পর্শ করে না।
রিমির হাত থেকে তৌহিদ পানের পিরিচ নিল। এমনভাবে নিল যেন সে জানত রিমি তার জন্যে পান-সিগারেট নিয়ে আসবে। এর জন্যে আলাদা করে কোনো ধন্যবাদ দেয়ার দরকার নেই।
তৌহিদ বসে আছে চেয়ারে। তার দৃষ্টি খাটের দিকে। খাটের মাঝখানে অনি কোলবালিশ নিয়ে ঘুমুচ্ছে। বিশাল খাটের মাঝখানটায় তাকে এতটুকু দেখাচ্ছে। তৌহিদ বলল, খাটটা আমার কাছে সমুদ্রের মতো লাগে। খাটটা কী বিশাল।
কী যে তুমি বল, এমন কী বিশাল? আমার দাদার আমলের খাট। ঐ সময় সব জিনিস বড়-বড় করা হত।
তা ঠিক। এখন আমরা যত সভ্য হচ্ছি; সব জিনিসও ছোট হচ্ছে।
ছোটই তো ভালল।
তা ঠিক, তবে কেন যেন শোবার খাটটা প্ৰকাণ্ড না হলে আমার আলো লাগে না। খাটটা হবে প্রকাণ্ড। যখন ঘুমুব মনে হবে সমুদ্রে শুয়ে আছি। তাই না?
রিমি তাকিয়ে আছে। হা, লোকটাকে এখন খুশি-খুশি মনে হচ্ছে। বেশ খুশি।
তৌহিদ বলল, ডাক্তার আমাকে কক্সবাজার যেতে বলল।
রিমি আশ্চর্য হয়ে বলল, কই, সে কথা তো বল নি।
আরে দূর-দূর, বললেই যাওয়া যায় না-কি?
কোনো কারণ আছে বলেই নিশ্চয় বলেছে।
কোনো কারণ নেই। কথার কথা; এম্নি বলেছে।
বিছানায় ঘূমতে যাবার ঠিক আগমহৰ্তে তৌহিদ বলল, একবার অবশ্য কক্সবাজার গেলে মন্দ হয় না। সমুদ্র কনো দেখা হয় নি। তুমি দেখেছ রিমি?