লোকটির গায়ে একটা গোলাপি রঙের গেঞ্জি। ত্রিশ বত্রিশ বছরের কোনো মানুষ কি গোলাপি গেঞ্জি গায়ে দেয়। পরনের প্যান্টের রঙ ঘন নীল। পায়ের জুতো সাদা। সাদা-নীল-গোলাপি এই তিনটি রঙের আলাদা কি কোন প্রভাব আছে? এত চমৎকার লাগছে তাকিয়ে থাকতে।
লোকটি রিমিকে দেখেও উঠে দাঁড়াল না। যে ভাবে বসা ছিল সেই ভাবেই বসে রইল। একটা পায়ের ওপর অন্য পা-টা রাখা। সেই পা অল্প-অল্প দুলছে। রিমি বলল, কে?
লোকটি বলল, আন্দাজ কর তো কে?
রিমি সঙ্গে-সঙ্গে চিনতে পারল। তার সারা গা বেয়ে শীতল সম্রাত বয়ে গেল। কেন সে প্রথম দেখাতেই চিনল না? নাকি প্রথম দেখাতেই চিনেছিল—শুধু ভান করেছিল যে চিনতে পারে নি? এই লোকটিকে কি এখন ভালো করে চেনা উচিত? বা চিনতে পারলেও কি বেশি সময় তার সামনে থাকা উচিত?
রিমি, চিনতে পেরেছ তো?
রিমি জবাব দিল না। চুপ করে রইল।
তুমি কি দাঁড়িয়ে থাকবে না বসবে? তোমার নিজের ঘরে তো আর তোমাকে আমি বসতে বলতে পারি না। আমি নিজেই তোমার অনুমতি ছাড়া বসে আছি।
রিমি বসল।
আমি যে আজই প্রথম এসেছি তা না, আগেও একদিন এসেছিলাম। তোমাদের কারো সঙ্গে দেখা হয় নি। তুমি, তোমার স্বামীকেউ ছিলে না। তোমার ছোট মেয়েটির সঙ্গে দেখা হয়েছে। ওর নাম বোধহয় অনি, তাই না?
হুঁ।
অনি বলে নি আমার কথা?
বলেছে—সেটা যে তুমি বুঝতে পারি নি।
রিমি বুঝতে পারছে তার কপাল ঘামছে। বুক ধকধক করছে। তার পরিষ্কার মনে পড়ছে সেদিন অনির হাতে ছিল বিশাল এক টিন চকলেট। অনি শুধু বলেছে একটা লোক তাকে দিয়েছে। লোকটা কে, কী, কিছুই বলে নি। অচেনা-অজানা একটা লোকের কাছ থেকে চকলেটের টিন নেবার জন্যে রিমি বরং রাগই করেছে। সেই অচেনা লোকা যে এতা কে জানত।
লোকটা হাসতে হাসতে বলল, প্রায় তের বছর পর দেখা, চিনতে পারবে কি পারবে না ভয়টা সব সময়ই ছিল। একবার ভাবলাম দাড়িগোঁফ কামিয়ে আসি। মুখ ভর্তি দাড়িগোঁফ অবস্থায় তো তুমি আমাকে কখনো দেখ নি—আমি নিজেই একনাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছি। তুমি তো কিছুই বলছ না। তোমার কি অস্বস্তি লাগছে?
না।
অস্বস্তি লাগা উচিত নয়। তের বছর আগে তোমার সঙ্গে কিছু পরিচয় ছিল, ঐ পরিচয়ের সূত্র ধরে এসেছি। আমি এর মধ্যে অন্যায় কিছু দেখছি না। তুমি দেখছ কি-না জানি না।
তুমি বস, আমি এক্ষুনি আসছি।
তোমাকে উঠতে হবে না। আমি চা-কফি, খাবারদাবার কিছু খাব না। তিন মিনিটের মধ্যে উঠব। আমার একটা এ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। তা ছাড়া তুমি খুব বেশি রকম নার্ভাস হয়ে আছ। এত নার্ভাস হবার কোনো কারণ দেখছি না।
আমি নার্ভাস হই নি।
হয়েছ। আগে তুমি আমাকে কখনো তুমি করে বল নি। এখন বলছ। এটা নাভাস হবার লক্ষণ। এত নার্ভাস হচ্ছ কেন?
রিমি কিছু বলল না। মুখ লাল করে বসে রইল। আসলেই তো ফরহাদ ভাইকে সে কখনো তুমি করে বলে নি। সে এত বড় ভুল কী করে করল?
তোমার ঘর-দুয়ারতো খুব গোছানো।
আপনি কি ভেবেছিলেন অগোছানো দেখবেন?
আমি যা ভেবে রেখেছিলাম তা হয় নি। আমি ভেবেছিলাম খুবই বড়লোকের ঘরে তোমার বিয়ে হবে। বিরাট বাড়ি থাকবে, গাড়ি থাকবে, মালী থাকবে।
আমার মতো দরিদ্র অবস্থা দেখে নিশ্চয়ই মনে-মনে খুশি হয়েছেন?
খুশি হব কেন? আমি যে ছোট মনের মানুষ না-তা তো তুমি জান রিমি, জান না?
জানি।
উঠি। তিন মিনিট হয়ে গেল। অন্য এক সময় এসে তোমার স্বামীর সঙ্গে পরিচয় করে যাব।
কবে আসবেন? তুমিই বল।
রিমি কিছু বলতে পারছে না। তার সব কিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সে এই মানুষটাকে সত্যি-সত্যি আসতে বলছে। বলা কি উচিত?
ফরহাদ উঠে দাঁড়াতে-দাঁড়াতে বলল, শুক্রবার যদি তোমাদের কোনো প্রোগ্রাম না থাকে তাহলে তোমাদের সঙ্গে এসে ডিনার করতে পারি। আছে কোন প্রোগ্রাম?
না।
তাহলে এই সেটেড হল। আমি সন্ধ্যা সাতটা সাড়ে সাতটার দিকে চলে আসব।
ফরহাদ চলে যাবার পরেও এই ঘরে প্রায় পনের মিনিট রিমি একা-একা বসে। রইল। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। শরীর কাঁপছে। বুক ফেটে যাচ্ছে তৃষ্ণায়।
কোনো কথা দ্বিতীয়বার বলতে
কোনো কথা দ্বিতীয়বার বলতে তৌহিদের ভালো লাগে না। মানুষের জীবনটা এমন যে–যা ভালো লাগে না–নিজ জীবনে তা ফিরে ফিরে আসে। তৌহিদের বাবা কানে কম শুনতেন। তিনি প্রতিটি প্রশ্ন তিনবার চারবার করে জিজ্ঞেস করতেন। রিমি কানে খুব ভালো শোনে তবু তার বিশ্রী অভ্যাস, প্রতিটি প্রশ্ন কয়েকবার করে জিজ্ঞেস করে।
ডাক্তার বলল তোমার কোনো সমস্যা নেই।
হুঁ।
হুঁ আবার কী, ঠিক মতো বল, ডাক্তার কীভাবে বলল কথাটা?
বলল, আপনার কিছু হয় নি।
বললেই হল? আমার চোখের সামনে দেখছি তুমি নিঃশ্বাস নিতে পারছ না। দম বন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছ আর ডাক্তার বলেছে কিছু হয় নি।
বললে কী আর করা।
তুমি প্রতিবাদ কর নি?
প্রতিবাদ কি করব? আমি তো ডাক্তার না। স্কুল মাস্টার।
স্কুল মাস্টাররা প্রতিবাদ করে না?
না। ওরা ছাত্রদের ধমক-ধামক দেয়। ঐ পর্যন্ত। MRCP ডাক্তারের সঙ্গে প্রতিবাদ করব আমার এত সাহস আছে? তাছাড়া ডাক্তার ঠিক কথাই বলেছে।
ডাক্তার ঠিক কথা বলেছে?
বলেছে ওটা মনের অসুখ।
রিমি বিরক্ত গলায় বলল, তুমি পরিষ্কার করে কিছু বলছ না কেন? ওটা মনের অসুখ এই কথা ডাক্তার কখন বলল? গুছিয়ে বল তো ব্যাপারটা কী? শুরু থেকে বল— তুমি ডাক্তারের ঘরে ঢুকলে; তখন ডাক্তার কী বলল?