বড় হৃদয়ের কথা আমাকে বলবে না। বড় হৃদয়, বড় মহৎ এইসব খুবই বাজে কথা। তুমি হচ্ছ গা-বাঁচানো মানুষ। তোমার কি মনে আছে, তোমাকে নিয়ে নিউ মার্কেটে গিয়েছিলাম? প্রচও ভিড়ের সুযোগে একটা লোক আমার বুকে হাত দিল।
তোমার মনে আছে?
আছে।
তুমি দেখেও না দেখার ভান করলে। এটা করলে কেন? তোমার হৃদয় বড় বলে? না, তা কিন্তু না। তুমি গা বাঁচাতে চাইলে। ঝামেলা এড়াতে চাইলে। তুমি যা চাও তা হচ্ছে কোনো ঝামেলা, কোনো যন্ত্ৰণা ছাড়া জীবনটা পার করে দিতে। স্ত্রীকে সামান্য ভালবাসলে যদি ঝামেলা কমে তাহলে সেই সামান্য ভালবাসাও তুমি দিতে প্রস্তুত আছ। আমার কথা শেষ হয়েছে, চল ঘুমুতে যাই।
চল।
আরেকটা শেষ কথা শুধু—এরপর থেকে আমি কিন্তু আর কোন দিন তোমার সঙ্গে শোব না। কোনদিন আমার গায়ে হাত দিতে পারবে না। আমার যাবার জায়গা নেই; কাজেই আমাকে থাকতে হবে তোমার সঙ্গে। কিন্তু আমি আবার পড়াশোনা করব। আবার বি.এ. পরীক্ষা দেব। অবশ্যই পাস করব। তারপর একটা চাকরি খুজে তোমাকে ছেড়ে চলে যাব।
তোমার যা ইচ্ছা তাই করবে। আমি বাধা দেব না।
তা দেবে না। বাধা দিলেই ঝামেলা। তুমি চাও ঝামেলাহীন একটা জীবন। রিমি এসে অনির পাশে শুয়ে পড়ল। তার কপালের শিরা দপদপ করছে। মাথায় অসহ্য যন্ত্ৰণা। সে ধরেই নিয়েছে আজ সারারাত তার ঘুম হবে না। অথচ কী আশ্চর্য, বিছানায় শুয়ে গভীর ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল। শেষরাতের দিকে সে জোবেদা খানমকে স্বপ্নে দেখল।
বৃদ্ধা মহিলা খুব করুণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছেন, তার চেয়েও করুণ গলায় বলছেন, বৌমা, তুমি শুধু-শুধু খোকার ওপর রাগ করছ। ও একবার আমাদের নেত্রকোনার বাসার পেছনের পুকুরে ডুবে গিয়েছিল। তারপর থেকে পানি খুব ভয় পায়। তুমি তো এই খবর জান। তারপরও কেন রাগ কর? পানি ভয় পায় বলেই তোমাকে নিয়ে সমুদ্রে নামে না।
আমি এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না।
তুমি মাথা ঘামাচ্ছ। তুমি আমার খোকার কাছে যাও। ওর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
রিমির ঘুম ভেঙে গেল। স্বপ্নের কোনো মানে হয় না। স্বপ্ন স্বল্পই। তবু এই স্বপ্নে কী যেন আছে। স্বপ্ন হয়েও এটা যেন স্বপ্ন না।
তৌহিদ পানি অসম্ভব ভয় পায় এটা সে জানে। সমুদ্রের কাছে আসার উত্তেজনায় ভুলে গিয়েছিল। অবচেতন মন তা মনে করিয়ে দিয়েছে। এর বেশি কিছু না। শ্বাসকষ্টের কথাটা ঠিক না। শ্বাসকষ্ট হলে তৌহিদ তাকে ডাকত।
রিমি উঠে বসল। ইলেকট্রিসিটি এখনো আসে নি। সে হাতড়ে-হাতড়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে তৌহিদের কাছে এগিয়ে গেল।
তৌহিদ জেগে আছে।
তার মুখ হাঁ হয়ে আছে। তার কপালে ঘাম। অসম্ভব যন্ত্রণায় ঠোঁট নীল হয়ে যাচ্ছে। চোখ ঘলাটে। রিমি রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, তোমার এত কষ্ট, কেন তুমি আমাকে ডাকলে না? কেন ডাকলে না?
ফিসফিস করে, যেন অতি দূরের কোনো জায়গা থেকে তৌহিদ বলল, রিমি, আমি মরে যাচ্ছি।
না তুমি মরছ না। তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে। ধর, তুমি আমার হাত ধর।
অনিকে দেখব। আমি অনিকে একটু দেখব।
তোমার কাউকে দেখতে হবে না। তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে। এই দেখ আমি তোমার হাত ধরে আছি।
নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।
পারবে। নিঃশ্বাস নিতে পারবে। কতক্ষণ ধরে এমন হচ্ছে?
অনেকক্ষণ।
কেন তুমি আমাকে ডাক নি?
নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।
রিমি জানালা খুলে দিল। পৰ্দা সরিয়ে দিল। তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। বাতাস আসুক। প্রচুর বাতাস। সমুদ্রের টাটকা হাওয়া এই ঘরের বদ্ধ বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যাক। রিমি কাঁপছে। সে নিজেও বুঝতে পারছে না যে তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে।
রিমি।
বল।
এক গ্লাস পানি দাও, যন্ত্রণাটা একটু কমেছে।
রিমি পানি গ্লাসে ঢেকে এনে দেখে তৌহিদ ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রচণ্ড কষ্টের পর একটু কষ্টটা কমলেই চোখে ঘুম আসে। রিমি মোমবাতি নিভিয়ে বারান্দায় এসে চোখ মুছল। ভোর হচ্ছে। পাখি ডাকছে। একজন দুজন রওনা হচ্ছে সমুদ্রের দিকে।
পাশের ঘরের দরজা খুলে জামাল সাহেব বের হয়ে এলেন। রিমির দিকে চোখ পড়তেই সে বলল, স্লামালিকুম।
জামাল সাহেব বললেন, আজ খুব ভোরে উঠেছেন মনে হচ্ছে।
জ্বি, আপনারা আজ চলে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ।
আর কখনো আপনাদের সঙ্গে দেখা হবে না?
জামাল সাহেব হাসিমুখে বললেন, হতেও পারে। আবার যদি কখনো সমুদ্রের পাশে আসেন তাহলে দেখা হবে। আমি প্রায়ই আসি।
রিমি চাপা গলায় বলল, আমি আর কখনো সমুদ্রে আসব না। কখনো না।
জামাল সাহেব সহজ গলায় বললেন, আনুশকা প্রতিবার এই কথা বলত। আবার আসত। আপনিও আসবেন।
জামাল সাহেবের স্ত্রী বের হয়ে এলেন। রিমিকে দেখে বললেন, তোমার কর্তা এবং কন্যা দুজনেই ঘুমুচ্ছে?
জ্বি।
কাল তোমার কর্তাকে দেখলাম কাকভেজা হয়ে ফিরছে। জ্বর হয় নি তো?
জ্বি না। শরীর একটু খারাপ হয়েছিল। এখন ভালো, ঘুমুচ্ছে।
তাহলে তুমি চল আমাদের সঙ্গে। শেষবারের মতো সমুদ্র দেখে আসি।
রিমি কয়েক মুহূর্ত ভাবল, তারপর বলল, চলুন। এক সেকেন্ড দাঁড়ান, আমি স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে আসি।
ঝড়ের পর শান্ত সমুদ্র।
কী নীল, কী নীল।
আকাশে-সমুদ্রে মাখামাখি হয়ে আছে। কোথায় সমুদ্রের শেষ, কোথায় আকাশের শুরু-বোঝাই যায় না। মনে হয় আকাশ সমুদ্রমেশা।
তারা তিনজন চুপচাপ দাঁড়িয়ে। রিমি বলল, আমি কখনো সমুদ্ৰে নামি নি।
জামাল সাহেবের স্ত্রী বললেন, কেন বল তো?
একা-একা নামতে ভয় লাগে। ও কখনো নামবে না। ওর পানির খুব ভয়। ও একবার পানিতে ডুবে গিয়েছিল।