তৌহিদ ঠিক করল সে একটি কথাও বলবে না। চুপ করে থাকবে। কথার পিঠে কথা না বললেই উৎসাহ হারিয়ে রিমি চুপ করে যাবে।
রিমি চুপ করল না। সে কথা বলে যেতে থাকল আপন মনে। কাউকে শোনাবার জন্যে নয়, যেন সে নিজেকেই শোনাতে চায়। রিমির গলার স্বর নিচু কিন্তু সে প্রতিটি বাক্য খুব স্পষ্ট করে উচ্চারণ করছে। রিমি বলছে, তোমার সঙ্গে বিয়ে হবার আগে একজন ডাক্তারের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছিল। ঐ ডাক্তার এফআরসিএস করতে বিলেত যাচ্ছিলেন। তাঁর সঙ্গে বিয়ে হলে আমিও বিলেত যেতাম, আমার অন্য একটা জীবন। হত। সেই জীবনটাও নিশ্চয়ই ভুল হত না?
এই আলোচনা থাক।
না থাকবে কেন? আমার অনেক কথা বলার আছে; আমি সেগুলি তোমাকে বলতে চাই। একজন আমি মেজরের সঙ্গে আমার বিয়ের কথা প্রায় পাকাপাকি হয়ে গিয়েছিল। তিনি প্রমোশন পেয়ে এতদিনে নিশ্চয়ই ব্রিগেডিয়ার-ফ্রিগেডিয়ার হয়েছেন। আর তুমি এগার বছর মাস্টারি করার পর এ্যাসিসটেন্ট হেডমাস্টার হয়েছে। তাও এ্যাকটিং পোষ্টে।
আমার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে এই কারণে তুমি কি মনে-মনে কষ্ট পাও?
হ্যাঁ পাই। আমি কখন স্কুল মাস্টার বিয়ে করতে চাই নি।
কী আর করবে বল, তোমার দুর্ভাগ্য।
দুর্ভাগ্য তো বটেই। উঠে যাচ্ছ কোথায়?
একটা সিগারেট খাব।
কেন, মাথা জাম হয়ে গেছে?
তৌহিদ উত্তর দিল না। বিছানা থেকে নেমে সিগারেট ধরাল। দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বৃষ্টি থেমে গেছে। তবে এখন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সমুদ্র এখান থেকে অনেক দূরে। তবু সমুদ্রের হুমহম ক্রুদ্ধ গর্জন কানে আসছে। রিমিও তৌহিদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে কান্না-কান্না গলায় বলল, আমার ভাগ্য আসলেই খারাপ।
তৌহিদ বলল, আমারও মনে হয় তোমার খুব ভালো একটা বিয়ে হতে পারত। ভালোভালো সব সম্পর্ক ভেঙে গিয়ে আমার মতো একজন অপদার্থের সঙ্গে তোমার বিয়ে হল এটাই আশ্চর্য।
কেন হল জান? হল কারণ তোমার মতো খোজখবর না নিয়ে কেউ বিয়ে করে। না। যাদের সঙ্গে বিয়ের কথা হয়েছে তারাই খোঁজখবর করেছে। যখন জানতে পেরেছে আমি একটা ছেলের সঙ্গে একবার পালিয়ে গিয়েছিলাম তখনি পিছিয়ে গেছে। অবশ্যি ঐ মেজর সাহেব আমাকে দেখে এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তারপরও তিনি রাজি ছিলেন। বিয়ের দিন-তারিখও হয়ে গিয়েছিল।
তাহলে বিয়েটা হল না কেন?
হল না কারণ মেজর সাহেব একটা উড়ো চিঠি পেলেন। ঐ উড়ো চিঠিতে লেখা ছিল—আমি যে শুধু পালিয়ে গিয়েছিলাম তাই না, গৌরীপুরের একটা হোটেলে রাতও কাটিয়েছিলাম। হোটলটার নাম শাস্তি বোর্ডিং। তোমরা এরকম কোনো উড়ো চিঠি পাও নি?
না।
যদি পেতে হলে কি বিয়ে ভেঙে দিতে?
তোমার কী হয়েছে বল তো রিমি। আমি দেরি করে ফেরায় তুমি যদি রাগ করে থাক তাহলে হাতজোড় করে ক্ষমা চাচ্ছি। এস আমরা ঘুমুতে যাই। সকালে ঘুম ভাঙলে মন শান্ত হবে।
আমার মন শান্তই আছে। তোমার মনও শান্ত। তোমার শান্ত মনকে একটু শুধু অশান্ত করব। গল্পটা পুরোপুরি বলব। আজই শুধু বলব। আর কোনোদিন বলব না। বস, চেয়ারটায় বস। আমার দিকে তাকাও।
তাকালেও তো তোমাকে দেখতে পারছি না। বারান্দা অন্ধকার।
অন্ধকার হলেও তাকাও।
তৌহিদ তাকাল। রিমি কথা শুরু করল, ওর সঙ্গে আমি রওনা হলাম ভোরবেলা। ট্রেনে করে। গৌরীপুর স্টেশনে আমরা নামলাম। উনি আমাকে লেডিজ ওয়েটিং রুমে বসিয়ে চা আনতে গেলেন। আমি বসে আছি, হঠাৎ মেজো চাচা সেখানে ঢুকে অবাক হয়ে বললেন, তুই এখানে কোথায় যাচ্ছি, কার সঙ্গে যাচ্ছি? আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। কী বলব ভেবে পেলাম না। মেজো চাচা বললেন, কি রে, তার বাবা-মা কোথায়? কার সঙ্গে এসেছিস? আমি বললাম, মার সঙ্গে নেত্র চাচা বললেন, তোর মা কোথায়? আমি বললাম, চাচা আপনি এখানে দাঁড়ান, আমি মাকে ডেকে আনছি। মা কলে হাত ধুতে গেছে। বলেই ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। ঘর থেকে বের হয়েই ফরহাদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হল। দুজনে ছুটলাম ওভার ব্রিজের দিকে। মেজো চাচা আমাদের আর খুঁজে পেলেন না।
একরাত আমরা কাটালাম গৌরীপুরের সেই হোটলে। পরদিন সেই হোটেল থেকে আমাকে উদ্ধার করা হয়। মেজো চাচা ছিলেন, থানার ওসি ছিলেন, আরো অনেকেই ছিল—এই হচ্ছে আমার গল্প।
তৌহিদ বলল, রিমি, এই গল্প আমি জানি।
তুমি জান।
হ্যাঁ জানি। বিয়ের পর শুনেছি শান্তি বোর্ডিং-এর দোতলায় ছয় নম্বর ঘরে তোমরা ছিলে। তোমাদেরভাবভঙ্গি দেখে বোর্ডিং-এর ম্যানেজারের সন্দেহ হয়। সেই পুলিশে খবর দেয়। তুমি ঐ বোর্ডিং-এ পা দেয়ার পর থেকেই খুব কান্নাকাটি শুরু করেছিলে।
রিমি বলল, তুমি ছাড়া এই ঘটনা আর কে জানে? তোমার মা জানেন?
হ্যাঁ জানেন।
তিনি শুনে কী বলেছিলেন?
তিনি বলেছিলেন, ও বাচ্চা একটা মেয়ে। এরা অনেক ভুল করে। সে একটা ভুল, করেছে—তুই ক্ষমা করে দে।
রিমি শব্দ করে হাসল। তৌহিদ কঠিন গলায় বলল, হাসছ কেন? মা কি কোনো হাসির কথা বলেছিলেন?
অবশ্যই। তিনি বলেছিলেন গা বাঁচানো কথা। তোমার মা অত্যন্ত বুদ্ধিমতী মহিলা। তিনি পরিবারের স্ক্যান্ডেল প্রচার হোক তা চান নি। তুমিও চাও নি। তুমি চাও নি কারণ তুমি হচ্ছ মেরুদণ্ডহীন একজন স্কুল মাস্টার। তোমার কিল খেয়ে কিল হজম করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। তুমি খুব ভালো করেই জানতে একটি বউকে বিদেয় করে দিলে দ্বিতীয় একজনকে জোগাড় করা তোমার জন্যে শক্ত। তারচে এই তো ভালো। সুন্দরী একটি মেয়েমানুষ হাতের কাছে আছে। ঘরের কাজকর্ম করছে। রাতে শারীরিক প্রয়োজনেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে। তৌহিদ নিচু গলায় বলল, তুমি একটা জিনিস ভুলে যাম্ রিমি। আমি খুবই তুচ্ছ এবং নগণ্য একজন মানুষ তা ঠিক, কিন্তু তুচ্ছ নগণ্য একজন মানুষের হৃদয়ও তো বড় হতে পারে।