হ্যাঁ। তুমি যদি না নাও, তাহলে ও কষ্ট পাবে।
আপনি উনাকে অসম্ভব ভালবাসেন?
তা বাসি। সবার ভালবাসা তো এক রকম নয়। আমি ভালবাসি আমার মতো করে। তুমি ভালবাসবে তোমার মতো করে। যাই, কেমন?
আপনারা কি কাল সকালেই চলে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ আমরা খুব ভোরে রওনা হব। তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে না।
তৌহিদ ফিরল রাত দশটায়।
সে কাকজো হয়ে আছে। মশারি একটা কিনেছে, সেই মশারি ভিজে ঢোল। তার কেনা সিগারেট অবশ্যি রক্ষা পেয়েছে। পলিথিনের ব্যাগ দিয়ে মোড়া ছিল বলেই এই অসাধ্য সাধন হয়েছে। তৌহিদ বিব্রত বোধ করছে। টর্চও কেনা হয়েছে। এতক্ষণ আলো দিচ্ছিল। কিন্তু সার্কিট হাউজের সিঁড়িতে পা দেয়া মাত্র টর্চের আলোও নিভে গেল। পানি চুইয়ে ভেতরে ঢুকে কিছু-একটা হয়েছে।
তৌহিদ অত্যন্ত বিব্রত বোধ করছে। সবচে বড় ভয় রিমিকে নিয়ে। সে যে ভয়াবহ রকমের রাগারাগি করবে, এটা বলার জন্যে জ্যোতিষী হওয়া লাগে না। এতক্ষণ ধরে বাইরে, সে নিশ্চয়ই ভয় পেয়েছে। খুব অন্যায় হয়েছে। ঘর থেকে বের হওয়াটা ঠিক। হয় নি। কী হত সিগারেট না খেলে?
রিমি কিছুই বলল না। শুকনো টাওয়েল এগিয়ে দিয়ে সহজ স্বরে বলল, মাথা মুছে ফেল। তার গলার স্বরে রাগের কোনো আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। অবশ্যি এটা ঝড়ের পূর্বলক্ষণও হতে পারে।
তৌহিদ ক্ষীণ স্বরে বলল, ঢাকার সঙ্গে এই জায়গার তফাৎ কি জান? ঢাকায় বৃষ্টি-বাদলায় রিকশা বেশি পাওয়া যায়। বেশি ভাড়ার লোভে সব রিকশাওয়ালা রিকশা বের করে ফেলে। এখানে আকাশ একটু অন্ধকার হলেই সব রিকশাওয়ালা রিকশা তুলে রেখে বাড়ি চলে যায়। খাবার দিয়ে গেছে রিমি?
হ্যাঁ।
অনি খেয়েছে?
হ্যাঁ।
তুমি বোধ হয় খাও নি। মোমবাতি তো শেষ হয়ে এল। আরো আছে, না এটাই সর্বশেষ?
আর একটা আছে। তুমি হাত-মুখ ধুয়ে আস। খেতে বসে যাই। সব বোধহয় ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।
তৌহিদ মনে-মনে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মনে হচ্ছে রিমি তেমন রাগ করে নি। অবশ্যি মুখের ভঙ্গি এখনো খানিকটা কঠিন।
আরো আগেই আসতাম। রাস্তা হারিয়ে ফেললাম। অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না।
টর্চ তো কিনেছ দেখি।
টর্চের আলোয় কিছু বোঝা যায় না। ছোট্ট একটা জায়গায় আলো পড়ে। আজ কী খাবার দিয়েছে?
মুরগির গোশত আর রূপচান্দা মাছ। ভাজি আছে, ডাল আছে। অনেক খাবার।
খাবার ঠাণ্ডা হলেও তৌহিদ প্রচুর খেয়ে ফেলল। পয়সায় কেনা খাবার নষ্ট করা ঠিক না এই বলে প্লেটে খাবার তুলতে লাগল।
রান্নাটাও ভালো হয়েছে, তাই না রিমি?
হ্যাঁ।
ঝাল অবশ্যি বেশি দিয়েছে। ঝালটা মাকের জন্যে খারাপ তবে হার্টের জন্যে ভালো। বিশেষ করে কাঁচামরিচ। কাঁচামরিচ হ্ৰষসিসের জন্যে একটা চমৎকার মেডিসিন। তুমি যদি ডেইলি একটা করে কাঁচামরিচ খাও; তোমার কোনদিন থ্রম্বসিস হবে না।
রিমি বলল, তুমি দেরি করে আসায় আমি রাগ করি নি। কাজেই আমাকে খুশি করার জন্যে শুধু-শুধু কথা বলতে হবে না।
তৌহিদের অস্বস্তির সীমা রইল না। তার অকারণে কথা বলার রহস্য রিমি ঠিকই ধরেছে।
আজ আর কার্পেট বিছানো হল না। ঠাণ্ডা পড়েছে। কম্বল গায়ে দিতে হবে। খাটেই বিছানা তৈরি হল। তৌহিদ বলল, তুমি বরং অনির সঙ্গে শোও। ও একা আছে। বিদ্যুৎ চমকালে ভয়-টয় পাবে।
ভয় পাবে না।
মোমবাতি নিভিয়ে রিমি ঘুমুতে এল। তৌহিদ বলল, তুমি কি জরুরি কিছু আমাকে বলবে?
হ্যাঁ। কী করে বুঝলে?
তুমি যেমন আমার মনের কথাটা ধরে ফেল, আমিও তোমারটা ধরতে পারি। সব সময় পারি না। মাঝে-মাঝে পারি। কী বলবে?
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে রিমি বলল, তুমি কি আমাকে ভালবাস?
অবশ্যিই বাসি।
না বাস না। আমাকে তুমি ভয় পাও। ভালবাস না।
যাকে ভয় পাওয়া যায় তাকে বুঝি ভালবাসা যায় না?
হয়ত যায়; তবে আমার জন্যে তোমার মনে কোনো ভালবাসা নেই।
এমন গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার কখন করলে? আজ?
আবিষ্কার অনেক আগেই করেছি, আজ শুধু বললাম।
কী দেখে তুমি এমন সিদ্ধান্তে চলে এলে, সেটা আমাকে বল। আমি তোমাকে নিয়ে কোনো কবিতা লিখি নি বা রং-তুলি দিয়ে তোমার ছবি আঁকার চেষ্টা করি নি। তার কারণ তোমার প্রতি আমার ভালবাসা নেই তা কিন্তু না, তার কারণ আমি কবিতা লিখতে পারি না। ছবিও আঁকতে জানি না।
রিমি হালকা গলায় বলল, আবিষ্কার কখন করলাম জান?
কখন?
ফরহাদ ভাইয়ের ব্যাপারটা জানার পরও তুমি যখন চুপ করে রইলে, কোনোরকম কৌতূহল দেখালে না তখন বুঝলাম আমার প্রতি তোমার কোনো আগ্রহ নেই। আমি অতীতে কী করেছি না করেছি তাতে তোমার কিছুই যায়-আসে না।
তৌহিদ শান্ত গলায় বলল, ব্যাপারটা সেরকম নয় রিমি। তখন তোমার বয়স ছিল নিতান্তই অল্প। অল্প বয়সে একটা ভুল করেছ…
ভুল করেছি বলছ কেন? এমনও তো হতে পারে ঐ দিন যা করেছিলাম ঠিকই করেছিলাম। বল, হতে পারে না?
হ্যাঁ পারে। হতে পারে।
ফরহাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে হতে পারত, পারত না? না?
হ্যাঁ পারত।
আজ আমার যে সংসার আছেতাঁকে নিয়েও এম্নি একটা সংসার নিশ্চয়ই হতে পারত। আজ যেমন তোমাকে নিয়ে সমুদ্রের কাছে এসেছি, তখন তাঁকে নিয়ে আসতাম। তুমি আমার হাত ধরে আমাকে সমুদ্রমানে নিয়ে যাও নি। তিনি হয়ত যেতেন। কাজেই তাঁর সাথে পালিয়ে গিয়ে ভুল করেছি আর তোমাকে বিয়ে করে শুদ্ধ কাজটা করা হয়েছে এটা বলছ কেন?
তৌহিদ কিছু বলল না। রিমি যে খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে তা সে জানে। বিশেষ করে সে যখন রেগে যায় তখন খুব যুক্তি দিয়ে কথা বলে। এমনভাবে কথা বলে যে প্রতিটি বাক্য বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে।