আপনার মেয়ের নাম কি?
মুনিয়া। খুব আশা ছিল মুনিয়া পাখির মত সারাক্ষণ কিচির-মিচির করবে। মেয়ে এ রকম হবে জানলে এর নাম রাখতাম উটপাখি। উটপাখি কোনো সাড়াশব্দ করে না।
ভদ্রমহিলা শব্দ করে হাসলেন।
রিমির মনে হল, মানুষে-মানুষে কত তফাৎ হয়। কত বড় অফিসারের স্ত্রী অথচ কী সহজ স্বাভাবিক ব্যবহার।
রিমি বলল, আপনাদের খুব মজা, দেশে-বিদেশে ঘুরেঘুরে বেড়ান।
তোমাদের বুঝি খুব বেড়াতে ইচ্ছা করে?
হ্যাঁ।
খুব ভালো ইচ্ছা বেড়াবে। বেড়ানোর মানেই যে দিল্লি-আজমির যেতে হবে তা তো না—তুমি যদি রিকশা করে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে যাও, গাছগুলোর দিকে তাকাও; সেটাও বেড়ানো। তাই না?
রিমি ভদ্রমহিলার সঙ্গে একমত হল না। তবু হা-সূচক মাথা নাড়ল। ভদ্রমহিলা বললেন, আমার বেড়াতে যে খুব ভাল লাগে তা না। বেনোর চেয়ে ভ্রমণকাহিনী পড়তে আমার ভালো লাগে। তবে জামাল অন্যরকম। সমুদ্র ওর খুব পছন্দ। এই যে বৃষ্টি হচ্ছে; ও বসে আছে সমুদ্রের পাশে।
রিমি বিস্মিত হয়ে বলল, সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি। সমুদ্র ওর কেন পছন্দ জান?
না।
ওর প্রথম স্ত্রী সমুদ্রের জন্যে পাগল ছিল। একবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সমুদ্রের পাশে থেকে সান-বাৰ্ন হয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। ওর শখ ছিল সমুদ্রের উপর যেখানে যত লেখা আছে জোগাড় করা। সে নিজেও সমুদ্র-বন্দনা নামে দীর্ঘ একটা রচনা শুরু করেছিল।
আশ্চর্য তো!
আশ্চর্যের কিছু নেই। প্রাণের প্রথম সৃষ্টি হয় সমুদ্রে। কাজেই বলা যেতে পারে আমরা উঠে এসেছি সমুদ্র থেকে। সমুদ্র হচ্ছে আমাদের আদি মাতা। আমাদের চোখের জল নোনতা, আমাদের রক্ত নোনতা, আমাদের রক্তে যে ঘনত্ব; সমুদ্রের পানিরও সেই একই ঘনত্ব। সমুদ্রের প্রতি আমরা এক ধরনের আকর্ষণ তো অনুভব করবই। আমাদের মধ্যে কেউ-কেউ সেই আকর্ষণ তীব্রভাবে অনুভব করে।
আপনি খুব গুছিয়ে কথা বলেন।
আমি গুছিয়ে কথা বলি, কারণ আমি একটা কলেজে পড়াই। কথা বলা হচ্ছে। আমার পেশা।
দমকা বাতাসে মোমবাতি নিভে গেল। রিমি বাতি জ্বালানোর জন্যে উঠে যাচ্ছে। ভদ্রমহিলা বললেন, উঠতে হবে না। তুমি বস। অন্ধকারই ভালো।
রিমি বলল, আপনার চিন্তা লাগছে না?
তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, চিন্তা লাগবে কেন?
উনি একা-একা সমুদ্রের কাছে আছেন।
ও তো ছেলেমানুষ নয়। ও যা করবে বুঝেশুনেই করবে।
যদি সমুদ্রে নামেন? নিশ্চয়ই খুব বড়-বড় ঢেউ উঠছে।
সমুদ্ৰে নামবে না। ও কখনো সমুদ্রে নামে না। আনুশকা যখন ছিল তখন তাকে নিয়ে নামত। সেই স্মৃতি ধরে রাখতে চায় বোধহয়। কিংবা হয়ত ওর সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল ওকে ছাড়া কখনো সমুদ্রেনামবে না। নববিবাহিত স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীরামজারমজার চুক্তি করে। কেউ-কেউ সেসব মনে রাখে। কেউ-কেউ রাখে না। আমি অবশ্য কখনো জিজ্ঞেস করি নি। জিজ্ঞেস করতে ভালো লাগে না।
তাঁর গলার স্বর কোমল। কিছুটা হয়ত আর্দ্র। তিনি কিছুক্ষণ চপ করে থেকে বললেন, তোমার হয়ত ধারণা হচ্ছে আমি প্রচুর বকবক করি। তাই না?
আমার এমন কিছু মনে হচ্ছে না। আপনি গল্প করছেন, আমার শুনতে ভালো লাগছে।
আমি যে খুব গল্প করি তাও না। আমার স্বভাবও অনেকটা আমার মেয়ের মতোই। চুপচাপ নিজের মনে থাকি। বইটই পড়ি।
আপনি যে আমার সঙ্গে কথা বললেন তার জন্যে কি আপনার খারাপ লাগছে?
না খারাপ লাগছে না। ভালোই লাগছে। তবে কেন এত বললাম সেটা তোমাকে ব্যাখ্যা করি। ব্যাখ্যা না করলেও হয়, তবু করি। তুমি দেখতে অবিকল আনুশকার মতো। ও আমাকে বলেছিল, আমি বিশ্বাস করি নি। তোমাকে দেখে বিশ্বাস হয়েছে।
আপনি কি উনাকে দেখেছিলেন?
না দেখি নি। ওর ছবি দেখেছি। আমাদের বাসায় তার অনেক ছবি বাঁধানো আছে। একজন মানুষের সাথে অন্য একজন মানুষের চেহারায় মাঝেমাঝে কাকতালীয় কিছু মিল দেখা যায়। সে রকম মিল। এই মিল ওকে খুব এফেক্ট করেছে। তোমাদের নিয়ে ও আজ হিমছড়ি গিয়েছিল, তাই না?
উনি যাচ্ছিলেন, আমাদের দেখতে পেয়ে তুলে নিলেন।
ব্যাপারটা তা না কিন্তু। সি-বীচে তোমাদের দেখে সে গাড়ি যোগাড় করল। আমাকে সব বলেছে। তুমি নিশ্চয়ই আমার কথা শুনে খুব বিব্রত বোধ করছ। তুমি পবিত্র ধরনের একটি মেয়ে। মানুষের বিচিত্র সব জটিলতার সঙ্গে তোমার হয়ত পরিচয় নেই। তোমাকে এসব জটিলতার সঙ্গে পরিচয় করানোও আমার উচিত হয় নি। তবু বলে ফেললাম। আমি আসলে খুব দুঃখী মেয়ে। ঝড়বৃষ্টির রাতে মানুষের মন দ্রবীভূত হয়ে থাকে। মনের কঠিন খাঁচা আলগা হয়ে যায়। গোপন দুঃখ সব বের হয়ে আসে। আমার দুঃখের গোপন কিছু কথা তোমাকে বলে ফেললাম, কিছু মনে করো না।
আমি কিছুই মনে করি নি।
আনুশকা যেভাবে ওর হাত ধরে সমুদ্ৰে নামতো আমারও তত সেইভাবে সমুদ্রে নামতে ইচ্ছা হতে পারে। পারে না?
নিশ্চয়ই পারে।
তুমি বাতি জ্বালাও, আমি এখন উঠব।
আরেকটু বসুন।
না যাই। তুমি মোমবাতিটা জ্বালাও তো।
রিমি বাতি জ্বালাল।
তিনি বললেন, আমি যদি তোমাদের মেয়েকে একটা উপহার দেই তুমি কি রাগ করবেঃ
রিমি বলর, কী যে বলেন। কেন রাগ করব?
আগে বল রাগ করবে না।
রাগ করব না।
তোমার মেয়ের জন্যে আমি একটা ক্যামেরা এনেছি। দেখতে মনে হয় খুব দামি, আসলে তেমন দামি নয়। তা ছাড়া জিনিসটা পুরানো। আমরা কিছুদিন ব্যবহার করেছি।
রিমি অস্বস্তি ভরা গলায় বলল, উনি ক্যামেরাটা দিতে বলেছেন তাই না?