আমরা তো গোসলের কাপড় আনি নি।
ভেজা কাপড়ে ফিরব। কোনো অসুবিধা নেই। আসুন।
সবাই পানিতে নেমে গেল। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয় বর্ষণ। প্রচণ্ড বৰ্ষণ। বৃষ্টির পানি বরফের চেয়েও শীতল। সুচের মতো গায়ে ফুটছে। সবাই দৌড়ে গাড়িতে চলে এল।
সমুদ্র ফুঁসতে শুরু করেছে। বাতাসের সঙ্গে-সঙ্গে একেকটা ঢেউ লাফিয়ে উঠছে – অনেক দূর। জামাল সাহেব বললেন, অবস্থা খুব ভালো মনে হচ্ছে না। তাড়াতাড়ি রওনা হওয়া ভালো।
অনি খুব সহজ গলায় বলল, চাচা আজ কি আমরা সবাই মারা যাব?
তোমার কী মনে হয়?
আমার মনে হয় মারা যাব।
অনিকে আসন্ন মৃত্যুচিন্তায় মোটও চিন্তিত মনে হল না। তাকে বরং উল্লসিতই মনে হল।
চার নম্বর বিপদ-সংকেত
চার নম্বর বিপদ-সংকেত দিয়েছে।
মাছ ধরার ট্রলারগুলোকে ফিরে আসার জরুরি বার্তা দেয়া হচ্ছে।
সমুদ্র সৈকতে বিপদ-সংকেতজ্ঞাপন লাল পতাকা উড়ছে। ছোট্ট সমুদ্র-শহর ঢেকে আছে অন্ধকারে। দমকা বাতাসে কয়েক জায়গায় বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে গেছে। – কিছুক্ষণ প্রবল বৃষ্টিপাতের পর ঝড়ো বাতাসে বৃষ্টি থেমে যাচ্ছে। থমথমে একটা অবস্থার সৃষ্ট হচ্ছে। আকাশে এক ধরনের অশুভ লাল আলো।
সার্কিট হাউস অন্ধকারে ডুবে আছে। ঘরে-ঘরে মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। মোমতাবির আলোয় সবকিছু কেমন অন্যরকম লাগছে। অনির ফুর্তির সীমা নেই। সে একটু পরপর বলছে, আমাদের খুব মজা হচ্ছে, তাই না মা?
রিমি বলল, হ্যাঁ হচ্ছে।
ঝড় আমাদের সবাইকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে, তাই না?
হ্যাঁ নেবে।
সমুদ্রের কাছে এলে এত মজা হয় কেন মা?
জানি না। এখন যাও তো তোমার বাবাকে গিয়ে বিরক্ত কর।
বড়রা এত বিরক্ত হয় কেন মা?
তাও জানি না।
এমন কেউ কি আছে যে সব প্রশ্নের উত্তর জানে?
উফ্ চুপ কর তো।
তৌহিদ বিষণ্ণ মুখে বসে আছে। তার প্রধান সমস্যা সিগারেট ফুরিয়েছে। ঝড়বৃষ্টির মধ্যে সিগারেট কেনার জন্যে কাউকে পাঠানোর প্রশ্ন ওঠে না। এই দীর্ঘ রজনী সিগারেট ছাড়া চলবে কীভাবে? এই মুহূর্তেই তার সিগারেট দরকার। একটা ছাতা জোগাড় হলে নিজেই বের হত। ছাতা সে পাবে কোথায়?
এখন অবশ্যি বৃষ্টি হচ্ছে না। বের হলে মন্দ হয় না। তৌহিদ শার্ট গায়ে দিতে-দিতে বলল, রিমি আমি একটু বাইরে যাচ্ছি, এক্ষুনি এসে পড়ব।
অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার, রিমি কিছুই বলল না। তৌহিদ নিছু স্বরে বলল, এখন বৃষ্টি হচ্ছে না। আবার শুরু হবার আগে-আগে চলে আসতে হবে।
রিমি বলল, যাচ্ছ যখন একটা মশারি কিনে এন। কাল রাতে অনিকে মশা কামড়েছে। এদের মশারি নেই।
ওষুধ তো আছে। ওষুধ স্প্রে করে দিক।
দরকার নেই, ওষুধের গন্ধে তোমার আবার শ্বাসকষ্ট শুরু হবে। মশারির সঙ্গে মনে করে সুতলিও কিবে আর একটা টর্চ। টাকা আছে তোমার কাছে?
আছে।
তৌহিদ ঘর থেকে বেরুবার পর কিছুক্ষণের মধ্যে আবার বৃষ্টি শুরু হল। সেই সঙ্গে দমকা বাতাস। অনি খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল বাবাকে কি বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে গেছে?
বড় বিরক্ত করছ অনি।
তুমিও বিরক্ত করছ মা।
যাও তো চুপচাপ শুয়ে থাক।
অনি রাগ করে তার বিছানায় শুয়ে পড়ল। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে ঘুমিয়েও পড়ল।
রিমি এখন একা।
প্ৰায়ান্ধকার ঘর। বাইরে ঝড়বৃষ্টির মাতামাতি। এর মধ্যে একা সময় কাটানোর আলাদা আনন্দ আছে। রিমি মনে-মনে ভাবল, তৌহিদ দেরি করে ফিরলে ভালো হয়। সে কিছু সময় একা থাকতে পারে। একা থাকার আনন্দ সে ভুলেই গেছে। বিয়ে হবার আগে একা থাকতে ইচ্ছা করলে ছাদে যেত। বর্তমানে বাড়ির ছাদে যাবার উপায় নেই। বাড়িওয়ালা সব সময় ছাদে তালা দিয়ে রাখে। একবার চাবির জন্যে জিতু মিয়াকে পাঠিয়েছিল। বলেছে চাবি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
বাথরুমে গোসলের সময়টা অবশ্য তার নিজের। রিমি দীর্ঘ সময় ধরে গায়ে পানি ঢালতে পছন্দ করে। তারও উপায় নেই। অনি এসে দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকবে, মা, ও মা। দরজা খোল মা।
পুরোপুরি নিঃসঙ্গ হবার কোনো ব্যবস্থা থাকলে ভালো হত। একটা ঘর থাকবে, যার দরজা বন্ধ করা মাত্র ঘরের আলো নিভে যাবে। বাইরের কোনো শব্দ সেই ঘরে ঢুকবে না।
রিমি ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল।
আর ঠিক তখন দরজার কড়া নাড়ল।
তৌহিদ কি এত তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে?
রিমি দরজা খুলে একজন অপরিচিত ভদ্রমহিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। মহিলা খুব মিষ্টি গলায় বললেন, আমি আপনাদের পাশের ঘরে থাকি। আমার স্বামীর সঙ্গে বোধ হয় আপনাদের পরিচয় হয়েছে জামাল হোসেন। আমার নাম রোকেয়া।
রিমি বলল, আসুন।
ভদ্রমহিলা ঘরে ঢুকতে-ঢুকতে বললেন, ও আজ দুপুরে আপনাদের অনেক গল্প করল। কাল আমরা চলে যাচ্ছি-ভাবলাম দেখা করে যাই।
খুব ভালো করেছেন। আমি যদি তুমি করে বলি তাহলে রাগ করবে? আমি বয়সে তোমার অনেক বড়। আমার বড় মেয়ে কলেজে পড়ে।
অবশ্যই আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন। বসুন। খাটে পা তুলে বসুন।
তোমার হাসবেন্ড কোথায়?
ও কোথায় জানি গেছে। কাঁচুমাচু মুখ করে বাইরে যেতে চাইল। বোধহয় সিগারেট আনতে গেছে।
মনে হচ্ছে খুব কঠিন শাসনে রাখছ। ঐ বুঝি তোমাদের মেয়ে?
জ্বি।
খুব না-কি ছটফটে মেয়ে? অনবরত কথা বলে?
রিমি হাসিমুখে বলল, ও আসলে খুব লাজুক। এখানে এসে যে কী হয়েছে, সারাক্ষণ কথা বলছে।
ভদ্রমহিলা বললেন, মুখে-মুখে কথা বলতে পারে এ রকম মেয়ে আমার খুব পছন্দ। আমার নিজের মেয়েটার মুখে কোনো কথা নেই। সমস্ত দিনে ছটা সাতটার বেশি শব্দ বলে কি-না সন্দেহ।