রিমি বলল, পারছি।
বলার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে না চিনতে পারছেন। বলেন তো কে?
কাল রাতে আপনার সঙ্গে কথা হয়েছে।
রাইট। রাতে আপনি এমন একটা ভঙ্গি করলেন যাতে মনে হল আপনি আমাকে খারাপ ধরনের ভিলেন ভেবে বসে আছেন। এইটা আপনার মেয়ে।
জ্বি। অনি, স্লামালিকুম দাও।
অনি বলল, আমি কাউকে স্লামালিকুম দিতে পারব না। ভদ্রলোক হাসিমুখে বললেন, আপনার স্বামী কোথায়?
ঐ যে।
যান আপনার স্বামীকে ডেকে নিয়ে আসুন আপনাদের হিমছড়ি দেখিয়ে আনি। সরকারি গাড়ি পাওয়া গেছে।
রিমি অস্বস্তির সঙ্গে বলল, দরকার নেই। আমরা সমুদ্রের কাছেই থাকব। অন্য কোথাও যাব না।
আপনাদের কোথাও যেতে হবে না। সমুদ্রের কাছেই থাকতে পারবেন। আমরা তীর ঘেঁষে-ঘেঁষে যাব।
না থাক।
আপনার অস্বস্তির কারণটা বুঝতে পারছি না। আপনি কি এখনো আমাকে ভিলেন ভাবছেন?
না।
আচ্ছা আমি আপনার স্বামীর সঙ্গে কথা বলছি। উনাকে দেখে মনে হচ্ছে উনি আপনার মতো এত কঠিন না। ভালো কথা, উনি কী করেন জানতে পারি? প্রফেশানটা আগে জানা থাকলে আলাপ জমাতে সুবিধা হয়।
উনি একজন স্কুল টিচার।
তাই নাকি? আমার বাবাও স্কুল টিচার ছিলেন। তাঁর ভয়ে আমরা থরথর করে কাঁপতাম। শুধু যে আমরা তাই আমার মা, খালা সবাই। আপনার স্বামী আশা করি তেমন ভয়ংকর না।
রিমি হেসে ফেলল। তার মনে একগাদা বালি জমে খচখচ করছিল। সমুদ্রের একটা বড় ঢেউ এসে সব ধুয়ে নিয়ে গেল।
জিপ দ্রুতগতিতে চলছে। মাঝেমাঝে ছুটছে হাতখানিক পানির ওপর দিয়ে। অনির বিস্ময়ের সীমা নেই। সে একটু পরপর বলছে, আমাদের এই গাড়ি জাহাজের মতে, তাই না বাবা? পানির ওপর দিয়ে যেতে পারে।
রিমির এই ভদ্রলোককে বেশ ভালো লাগল। তাঁর নাম জামাল হোসেন। বয়স পঞ্চাশের ওপর, দেখায় চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ। সিএসপি অফিসার। সরকারি কাজে এসেছেন। কাজ শেষ করেছেন। আগামীকাল ভোরে চলে যাবেন।
জামাল হোসেন বললেন, লোকজন হিমছড়িতে আসে খুব আগ্রহ নিয়ে। ভাবে বিশাল একটা জলপ্রপাত দেখবে। গিয়ে দেখে ছোট্ট একটা পানির ধারা। দেখে মনে হয় উঁচু পাহাড়ের মাথায় কেউ একটা পানির ট্যাপ খুলে দিয়েছে। তবু লোকজন আসে। হতাশ হওয়ার জন্যে আসে। অবশ্যি পুরাপুরি হতাশ হয় না।
হতাশ হয় না কেন?
হিমছড়িতে আসার পথে দীর্ঘ বেলাভূমি চোখে পড়ে। এই বেলাভূমির সৌন্দর্যের তো কোনো সীমা-পরিসীমা নেই, তাই না?
রিমি বলল, হ্যাঁ নাই। এত সুন্দর যে মন খারাপ হয়ে যায়।
আসলেই তাই। পৃথিবীর সব সুন্দর জিনিসের সামনে দাঁড়ালেই মন খারাপ হয়। এটা মানুষের বেলায়ও সত্যি। আমার প্রথম স্ত্রী খুব রূপবতী ছিল। সে এতই সুন্দর ছিল। যে তার দিকে তাকালেই মন খারাপ হয়ে যেত।
উনি কি মারা গেছেন?
হ্যাঁ। বিয়ের দুবছরের মাথায় চাইল্ড বার্থে। সেও বাঁচে নি। বাচ্চাটিও বাঁচে নি। আমার স্ত্রীর নাম ছিল আনুশকা। মৃত শিশুরও না-কি নাম প্রয়োজন হয়। কাজেই আমি আমার মৃত কন্যাটিরও নাম রেখেছিলাম। ওর নাম দিয়েছিলাম ছোট আনুশকা। ও তার মায়ের মতোই হয়েছিল। হয়তবা সে তার মায়ের চেয়েও সুন্দর হয়েছিল।
তৌহিদ মৃদুস্বরে বলল,এই অপ্রিয় প্রসঙ্গটা বাদ থাক ভাই সাহেব।
আচ্ছা বাদ থাক। চলুন আমরা আনন্দ করি। খুকী তোমার নাম কি?
আমার নাম বলতে ইচ্ছা করছে না।
তুমি কি গান জান খুকী?
আমার নাম অনি।
তুমি কি গান জান অনি?
জানি, কিন্তু গাইব না। আমার অবশ্যি একটা গান শোনার খুব ইচ্ছা করছিল।
অনি খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে যেন নিজের মনেই গাইছে এমন ভঙ্গিতে গান শুরু করল, আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে..
কচিকণ্ঠের গান। যে গানের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক করছে সমুদ্রের মতো বড় সুরকার, সেই গান তো অপূর্ব হবেই। সবার মন অন্যরকম হয়ে গেল। ড্রাইভার পর্যন্ত দুবার পেছনে ফিরে গায়িকাকে দেখল। তৌহিদ মুগ্ধ। তার মেয়ে এত সুন্দর গাইতে পারে তা সে কল্পনাও করে নি। কোত্থেকে সে গান শিখল?
জলপ্রপাত দেখে রিমি মুগ্ধ। সে ভেবেছিল দেখবে ছোট্ট জলের ধারা। দেখা গেল তা নয়, প্রবল বেগে পানি নেমে আসছে। জামাল হোসেন বললেন, বর্ষাকাল বলে এত পানি। আসলে এত পানি থাকে না।
অনি বলল, আমি আপনার কোলে উঠব।
অবশ্যই উঠবে। এস।
ভদ্রলোক অনিকে ঘাড়ে তুলে নিলেন। হাসিমুখে বললেন, শিশুদের অনেক অসাধারণ ক্ষমতার একটা হল সব কিছু নিজের করে নেয়া। যখন সে একটা গাড়িতে চড়বে তখন বলবে এটা আমাদের গাড়ি। যখন ট্রেনে চড়বে; বলবে আমাদের ট্রেন। এখন অনি আমার ঘাড়ে চড়ে মনে-মনে বলছে আমাদের মানুষ। হা-হা-হা। তৌহিদ সাহেব আপনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন কেন ছবি তুলুন।
তৌহিদ লজ্জিত মুখে বলল, আমাদের কোন ক্যামেরা নেই।
আগে জানলে আমারটা নিয়ে আসতাম। ওটা ফেলে এসেছি সার্কিট হাউসে আমার স্ত্রীর কাছে। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর আমি আবার বিয়ে করি। উচিত ছিল দেবদাস হয়ে যাওয়া, সেটা সম্ভব হয় নি।
রিমি জিজ্ঞেস করবে না করবে না করেও জিজ্ঞেস করে ফেলল, উনাকে নিয়ে আসেন না কেন?
ওর সমুদ্র ভালো লাগে না। ও প্রায়ই আসে কক্সবাজার। বেশিরভাগ সময় রেস্ট হউসে শুয়ে থাকে। বার্মিজ মার্কেটে শপিং করে। আপনাদের হয়তবা ধারণা হচ্ছে ও একটু অন্যরকম। আসলে তা না, ও চমৎকার একটি মেয়ে। আপনাদের সঙ্গে কথা হলেই বুঝবেন। আসুন জলপ্রপাতে স্নান করা যাক। অবশ্যি এটাকে জলপ্রপাত না বলে ঝরনা বলাই যুক্তিযুক্ত।