মিসেস রিমি?
জ্বি।
তোমার স্বামীটি কি এখনো ঘুমুচ্ছে?
জ্বি না; জেগেছেন। হাত-মুখ ধুচ্ছেন।
দ্যাটস নাইস। তাকে নিয়ে আমাদের সঙ্গে চল। একসঙ্গে সমুদ্র দেখব।
বেশ তো, চলুন।
আমি আবার বিরাট দলবল নিয়ে ঘুরতে পছন্দ করি। এখন দলের সদস্যসংখ্যা এগার। তোমরা দুজন এলে হবে তের। আনকি থারটিন।
আমার সঙ্গে আমার মেয়ে আছে।
বাঁচা গেল। আনলাকি থারটিন আর হতে হল না। এখন আমরা লাকি ফোর্টিন।
আগামীকাল আমরা যাব মহেশখালি। এখানকার ওয়াটার ডেভলপমেন্ট বোর্ডর। একটা সমুদ্রগামী জাহাজ আছে। ওরা ঐটি আমাদের একদিনের জন্যে ছেড়ে দিয়েছে। দুপুরের খাওয়াদাওয়া জাহাজেই হবে।
তোমার সঙ্গে তাহলে কাল সারাদিনের প্রোগ্রাম সেটেল করলাম। মনে থাকবে?
রিমি হাসিমুখে বলল, থাকবে।
ভেরি গুড। এই দেশে আসলে সত্যিকার অর্থে দেখার কিছু নেই। গত সামারে আমি আমার বড় ছেলের কাছে গিয়েছিলাম সিয়াটলে, অসাধারণ। যেমন প্রকৃতি তেমনি তার রক্ষণাবেক্ষণ। আমেরিকানদের কারবারই অন্যরকম। ইউরোপ দেখা হয়। নি। ইটালিতে আমার ছোট মেয়ে আছে। হাসবেত্ত আই স্পেশালিস্ট। আমাকে যেতে বলেছে। সামনের সামারে যাবার ইচ্ছা।
আপনার তো খুব মজা। ঘুরেঘুরে বেড়াচ্ছেন।
তা ঠিক। রিটায়াড় জীবন উপভোগ করার চেষ্টা করছি। অনেকে তা করে না। ভালো কথা, তোমার হাসবেন্ড কী করেন তাতো জানা হল না।
উনি মাস্টারি করেন। স্কুল টিচার।
স্কুল টিচার?
জাজ সাহেবের মুখ হঠাৎ একটু পানসে হয়ে গেল। মনে হল তিনি একটা ধাক্কা খেলেন। রিমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
একেবারে শেষপ্রান্তের ঘর থেকে পুতুলের মত একটি মেয়ে বের হয়ে বলল, গ্রান্ডপা, এস আমরা রেডি। জাজ সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, দেখি ওরা কদ্র কী করেছে।
বুড়োভদ্রলোক দলবল নিয়ে নিচে নামলেন। তৌহিদ তখন বারান্দায়। জাজ সাহেব তাঁর দল নিয়ে দোতলা থেকে একতলায় নামছেন। তিনি একবারও তৌহিদের দিকে ফিরে তাকালেন না।
তৌহিদ বলল, এই বুড়ো ভদ্রলোক কী অত পোশক পরেছেন দেখেছ? রিমি জবাব দিল না। তার কান্না পাচ্ছে। নিজেকে বড়ই তুচ্ছ ও ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে।
তৌহিদ বলল, অনিকে ডেকে তোল, চল যাই সমুদ্রে পা ভিজিয়ে আসি।
রিমি ক্লান্ত গলায় বলল, চল।
সমুদ্রের কাছে এসে রিমির মন বুড়িয়ে গেল। তার কাছে মনে হল ঐ জাজ সাহেব যত। বড়ই হোন তিনিও অতি ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ। সমুদ্র সব মানুষকে এক পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।
এখন জোয়ারের সময়।
সমুদ্র ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। আকাশে মেঘ জমেছে বলেই সমুদ্রকে যেন কালো দেখাচ্ছে। কালো জলের মাথায় হঠাৎ-হঠাৎ সাদা ফেনার ফুল ফুটেই আবার মিলিয়ে, যাচ্ছে। কী অসম্ভব সুন্দর।
অধিকাংশ মানুষই এই সৌন্দৰ্য উপেক্ষা করে ঝিনুক কুড়াচ্ছে। শিশুদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে বয়স্ক মানুষ। একটা জীবন্ত তারা মাছ বালির উপর ভেসে উঠেছে। তাকে ঘিরে একদল কৌতূহলী মানুষ। একটি বাচ্চা ছেলে মাকে জিজ্ঞেস করল, মা, তারা মাছ কি আমরা খাই?
মা ছেলেটির গালে ঠাস করে একটা চড় বৃসিয়ে দিয়ে বললেন, গাধা, সব জায়গায় গাধামি করে। স্টার ফিস তোক কখনো বেঁধে দিয়েছি যে জিজ্ঞেস করছিল?
লজ্জায়, অপমানে ছেলেটির চোখে পানি এসে গেল। সমুদ্র বোধহয় তা টের পেল। ছেলেটির মা সমুদ্রে নামামাত্র প্রবল একটা ঢেউ এসে মাকে উল্টে ফেলে দিল। তীরে দাঁড়ানো সবাই হেসে উঠল হো-হো করে।
ছোটে-ছোট জাল নিয়ে প্রচুর জেলে নেমেছে সমুদ্রে। তারা ধরছে চিংড়ি মাছের। পোনা। একেকটা পোনা তারা এক টাকা করে বিক্রি করবে। আজ জেলেদের ভাগ্য ভালো—প্রচুর পোনা ধরা পড়ছে।
স্নানের পোশাক পরা দুজন বিদেশিনী পানিতে নেমেছে। এদের অসম্ভব সাহস। এরা অনেক দূর চলে গেছে। হাত-পা ছড়িয়ে তারা নানা ভঙ্গিমায় পানির উপর নাচানাচি করছে। ওদের সঙ্গের পুরুষ দুজন পানিতে নামে নি। ভেজা বালুতে বসে বর্মী চুরুট টানছে এবং হাসাহাসি করছে। মেয়ে দুটি যে এত দূরে চলে গেছে তা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।
শুধু রিমির কেন জানি প্রচণ্ড ভয় করছে। মনে হচ্ছে-একটা বড় ঢেউ উঠে এসে মেয়ে দুটিকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।
একজন ভদ্রলোককে দেখা গেল গলা ফুলিয়ে পাশের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে তর্ক করছেন, আরে ভাই আমি তো না জেনে বলছি না। জেনেশুনেই বলছি। ভদ্রলোকের নাম হিরাম কক্স। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন ক্যাপটেন ছিলেন। তার নামানুসারে কক্সবাজারের নাম করা হয়।
আপনি কিছুই জানেন না। কসাহেব ছিলেন একজন ব্রিটিশ আইসিএস। তিনি এই জায়গা ঘুর করতে এসে নাম দেন কক্সবাজার, আগে এই জায়গার নাম ছিল বালু। বালু একটা বার্মিজ শব্দ, যার অর্থ নীল পানি।
দয়া করে এইসব আজগুবি কথা বলবেন না-তো।
আপনি দয়া করে ইতিহাস কপচাবেন না।
বাঙালি নিজের প্রেজেন্ট জানে না, পাস্ট নিয়ে চোঁচামেচি করে। আগে জানবেন প্রেজেন্ট, তারপর পাস্ট।
আপনি কিন্তু ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।
আর আপনি মূৰ্খামির সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।
শাট আপ।
ইউ শাট আপ।
রিমি অবাক হয়ে ওদের ঝগড়া শুনছে। দুজন বয়স্ক মানুষ শিশুদের মধ্যে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া করে? তাও সমুদ্রের কাছে এসে? এর কোন মানে হয়?
রিমির ঠিক গায়ের ওপর একটা পাজেরো জিপ হস করে থামল। ড্রাইভারের পাশে বসা মানুষটা নেমে এসে হাসি হাসি গলায় বলল, চিনতে পারছেন?