হুঁ।
প্রতিবছর একবার করে আসতে পারলে চমৎকার হত।
তা হত।
এখন থেকে বেড়ানোর জন্যে আলাদা করে টাকা জমাব, কি বল রিমি?
জমিও। ম্যাট্রিক পরীক্ষার খাতা দেখার টাকাগুলো আলাদা করে রাখলেই কিন্তু হয়।
চল শুয়ে পড়ি।
তোমার ঘুম পাচ্ছে?
হুঁ।
আর একটু বস। ঘুমে আমার নিজের চোখ জড়িয়ে আসছিল। এখন কেন জানি ঘুমটা কেটে গেছে। খানিকক্ষণ বস। গল্প করি। আমরা এইভাবে বসে কখনো তো গল্প করি না। তুমি কথা বল—আমি শুনি।
কি কথা বলব?
যা ইচ্ছা বল। নিজের কথা বল। বাবা-মার কথা বল। বা তোমার ছেলেবেলার কথা। তোমার যা ভালো লাগে। নিজের কোনো কথাই তো তুমি আমাকে বল না।
বলার মত কিছু নেই।
নিজের কথা কিছু বলতে ইচ্ছা করে না। আমার শৈশব খুব কষ্টে কেটেছে। আমার চার বছর বয়সে মা মারা গেলেন। বাবা আবার বিয়ে করলেন। সেই সমার ছিল মাথা খারাপ। বিয়ের পর সেটা ধরা পড়ল। উদ্ভট সব পাগলামি করতেন। আমাদের আদর করতেন আবার মাছ কাটা বঁটি দিয়ে কেটে দুটুকরা করতে চাইতেন।
বল কী।
ভয়াবহ অবস্থা। মার হাতে একটা বঁটি আর আমরা বোনরা ভয়ে আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে ছুটাছুটি করছি এটা ছিল খুব কমন দৃশ্য। মা বঁটি দিয়ে আমার বড়ববানের পায়ে একটা কোপ বসিয়েও ছিলেন। এই যন্ত্ৰণা অবশ্যি আমাদের বেশি দিন সহ্য করতে হল না। বাচ্চা হতে গিয়ে মা মারা গেলেন। বাবা আবার বিয়ে করলেন।
বাদ দাও। আমার এসব গল্প করতে ইচ্ছা করছে না। চল যাই ঘুমুই। ঘুম পাচ্ছে।
চায়ের কাপ তো নিতে এল না।
ভেতরে নিয়ে রেখে দেব। সকালে নেবে।
বিছানা কার্পেটের ওপরই হল। কার্বাডে কম্বল ছিল। সেই কম্বল বিছিযে তার ওপর চাদর দিয়ে দেয়া হল। তৌহিদ শুতে-শুতে বলল, আরামে বিছানা হয়েছে। সে তার স্ত্রীর পায়ের উপর পা তুলে দিয়েছে। এটাই তার ঘুমানোর স্বাভাবিক ভঙ্গি।
কিছুক্ষণে মধ্যেই তার নিঃশ্বাস ভারি হয়ে এল। রিমির ঘুম এল আরো অনেক পরে। সেই ঘুমও খুব গাঢ় নয়। এলোমেলো সব স্বপ্নে ঘুম ঠাসা। সেই সব স্বপ্নেরও কোন আগা-মাথা নেই। তবে শেষরাতের স্বপ্নটা সে খুব পরিস্কার দেখল। এত পরিষ্কার যে মনে হয় এটা আসলেই ঘটছে।
সে দেখল তার শাশুড়ি জোবেদা খানম কক্সবাজার সার্কিট হাউসের এই ঘরে এসেছেন। তিনি অসম্ভব বিরক্ত। চোখ কুঁচকে আছে রাগে। তিনি ঝাঁঝাল গলায় বললেন, এসব কী হচ্ছে বৌমা?
কিসের কথা বলছেন মা?
মাটিতে শুয়ে আছ কেন? খাট থাকতে মাটিতে শুয়ে থাকা এটা আবার কোন ঢং?
মাটি কোথায় মা? কার্পেটের ওপর শুয়েছি। তার ওপর কম্বল আছে। এই দেখুন না।
আর মেয়েটাকে মশারি ছাড়া ফেলে রেখেছ। মশা তো খেয়ে ফেলছে। মেয়েটাকে।
সমুদ্রের পাড়ে মশা থাকে না মা। হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে যায়।
এইসব ঢং-এর গল্প আমার সঙ্গে করবে না তো মা। ঢং-এর গল্প আমার। ভালো লাগে না। উঠে দেখ মশা মেয়েটাকে ছিলে ফেলেছে।
রিমি উঠে বসল। এতক্ষণ সে স্বপ্ন দেখছিল এই ধারণা মনে আসতেও তার . অনেক সময় লাগল। স্বপ্ন এত স্পষ্ট হয়। এত গোছানো হয়।
মনে হচ্ছে সত্যি-সত্যি তার শাশুড়ি এসেছিলেন। রিমি মেয়ের খাটের কাছে গেল। সত্যি-সত্যি বেশ কয়েকটা মশা রিমিকে ছেকে ধরেছে। রক্ত খেয়ে এক-একটা ফুলে কোলবালিশ হয়ে আছে। আহারে বেচারাকালই মশারির ব্যবস্থা করতে হবে। এদের না। থাকে তো একটা কিনে ফেলতে হবে। এম্নিতেই একটা মশারি কেনা দরকার। ওদেরটায় অনেকগুলো ফুটো।
রিমি জানালা খুলে দিল। ঘরে আলো আসুক। আলো এলে মশা থাকবে না। তেমন আলো ঢুকল না। কারণ অন্ধকার পুরোপুরি কাটে নি। রিমি ঘরের বাতি জ্বলে দিল। নিজে মুখ ধুয়ে তৌহিদের ঘুম ভাঙাল। ভোরবেলা একসঙ্গে সমুদ্র দেখতে যাবে। অনির ঘুম ভাঙাল না। সে আরো খানিকক্ষণ ধুমুক। তৌহিদের বাথরুমে অনেক সময় লাগে।
রিমি দরজা খুলে বারান্দায় এসেই হকচকিয়ে গেল। ওরা গতরাতে যে চেয়ারে বসেছিল সেখানে বুড়ো এক ভদ্রলোক বসে আছেন। বুড়ো ভদ্রলোকের পরনে হাফপ্যান্ট। গায়ে চক্ৰাবা শার্ট। সমানে পাইপ টানছেন। রিমিকে দেখে নাটকীয় ভঙ্গিতে মাথা ঝুকিয়ে বললেন, গুড মর্নিং ম্যাডাম।
রিমি কী বলবে ভেবে পেল না। বুড়ো ভদ্রলোক মুখ থেকে পাইপ সরিয়ে নিয়ে বললেন, লেট মি ইট্রডিউস মাইসে। আমি রিটায়ার্ড জাজ সিরাজুল ইসলাম। তুমি কে? তুমি করে বলার অপরাধ আশা করি ক্ষমা করবে। বয়সের সুযোগ গ্রহণ করছি।
হা-হা-হা।
আমার নাম রিমি।
মিস না মিসেস?
মিসেস।
মিসেস রিমি, তুমি যে একজন অসাধারণ রূপবতী মহিলা এই কথাটা নিশ্চয়ই আগে অনেকবার শুনেছ। তবু এই বৃদ্ধের মুখ থেকে আরেকবার শোন।
রিমি লজ্জা পেয়ে গেল। রিটায়ার্ড ডিস্ট্রিক্ট জাজ সিরাজুল ইসলাম হড়বড় করে কথা বলতে লাগলেন।
সারা বারান্দায় কোথাও চেয়ার নেই। তোমাদের এখানে চেয়ার দেখে এসে বসলাম। আমি আমার নাতি-নাতনিদের জন্যে অপেক্ষা করছি। ওরা সমুদ্রে যাওয়ার জন্যে সাজসজ্জা করছে। কতক্ষণ লাগবে কে জানে। আটাত্তর বছর বয়সেও আমি সবকিছুতে ফার্স্ট আর ওরা লাস্ট। হা-হা-হা। তুমি কি বসবে? বস এই চেয়ারটায়।
রিমি সহজ গলায় বল, আমি বসব না। আপনি বসুন। জাজ সাহেবদের পাশে বসতে আমার ভয় করে।
ভদ্রলোক মনে হল এই কথায় খুব লজ্জা পেলেন। হা-হা করে খানিকক্ষণ হেসে রিমির হাত ধরে পাশের চেয়ারে বসালেন। রিমির মনে হয়, এই যে নিতান্ত অপরিচিত একটি মেয়েকে উনি হাত ধরে পাশে বসালেন, এ কাজটা ঢাকায় তিনি নিশ্চয়ই করতেন না। এরকম উদ্ভট সাজপোকও করতেন না। সমুদ্রের হাওয়া হয়ত মানুষের মধ্যে খানিকটা পাগলামি ঢুকিয়ে দেয়।