আপনারা তো সার্কিট হাউসে উঠেছেন। আমি এবং আমার স্ত্রী ঐখানেই আছি চার নম্বর কামরায়। বিকেলে আপনাদের বের হতে দেখেছি। এই পরিচয়ের দাবিতে কথা বলতে এসেছি। একা-একা বসে আছেন কেন?
রিমি এখনো জবাব দিল না। তবে তার মুখের কাঠিন্য কিছুটা কমে এল। ভদ্রলোক বললেন, এখানে কিছু দুষ্ট ছেলেপুলে আছে। পরশু সন্ধ্যায় এক ভদ্রমহিলার ব্যাগ নিয়ে ছুটে পালিয়েছে। আপনার স্বামী কোথায়?
ঐ রেস্টুরেন্টে গিয়েছে।
আপনিও চলুন। আপনাকে আপনার স্বামীর কাছে দিয়ে আসি।
রিমির একবার ইচ্ছা হল বলে, আমাকে আমার স্বামীর কাছে পৌঁছে দেবার জন্যে আপনি এত ব্যস্ত কেন? কিন্তু সে কিছু না বলে সঙ্গে-সঙ্গে আসতে লাগল।
রিমি ভেবেছিল হাঁটতে-হাঁটতে হড়বড় করে এই লোক প্রচুর কথা বলবে। ভাব জমানো ধরনের কথা। এক ধরনের মানুষ আছে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার সামান্যতম সুযোগও ছাড়ে না। মেয়েদের শরীরের সামান্যতম স্পর্শের জন্যেও ভূষিত হয়ে থাকে। রিমি কিছুটা বিস্মিত হল। কারণ এই ভদ্রলোক সারাপথে একটি কথাও বললেন না। দোকানগুলোর উজ্জ্বল আলোর কাছে এসে শুধু বললেন, ঐ যে ওদের দেখা যাচ্ছে। আপনি যান।
রিমি লক্ষ করল ভদ্রলোক আবার সমুদ্রের কাছে ফিরে যাচ্ছেন। রিমির মনে হল এই ভদ্রলোককে আপনাকে ধন্যবাদ জাতীয় কিছু বলা উচিত ছিল। বলা হল না। তার মনটা একটু খচখচ করতে লাগল।
অনি ঝিনুকের একগাদা জিনিস কিনেছে। বিকট-দর্শন শুকনো কাঁকড়া মাছের মতো কী একটা কিনেছে যার লেজ সুতীক্ষ্ণ সুচের মতো। হাঙ্গরের একটা দাঁত কিনেছে। আরেকটা কিনতে চায় দাদীমার জন্যে। তৌহিদ মেয়েকে বুঝানোর চেষ্টা
করছে, একদিনে সব কিনে ফেললে কীভাবে হবে। আমরা তো আবার আসব।
না এক্ষুনি কিনব।
ঝিনুকের দোকানী বলল, স্যার একটা শংকর মাছের লেজ দিয়ে বানানো চাবুক নিয়ে যান।
তৌহিদ বলল, চাবুক দিয়ে কী করব?
মারামারি করবেন।
তৌহিদ বিস্মিত হয়ে বলল, কার সঙ্গে মারামারি করব? দোকানী দাঁত বের করে হাসছে। তৌহিদ বুঝল এটা এই দোকানীর একটি প্রিয় রসিকতা। অনেককেই সে হয়ত বলেছে মারামারি করার জন্যে একটা চাবুক নিয়ে যান।
তৌহিদ বলল, চাবুকের দাম কত?
অনি ঘুমুচ্ছে
অনি ঘুমুচ্ছে।
রাত মাত্ৰ নটা। অথচ মনে হচ্ছে নিশুতি। ঢাকার বাইরে গেলেই রিমির এমন হয়। নটা-দশটা বাজতেই মনে হয় মাঝরাত।
অনিকে একটা খাটে শোয়ানো হয়েছে। অন্য খাটটিতে রিমি এবং তৌহিদ শোবে। তৌহিদ বলল, দুজন এই খাটে ধরবে না। আমি নির্ধাৎ গড়িয়ে পড়ে যাব। এরচে বরং কার্পেটে শোয়া যাক। চাদর বিছিয়ে বিছানা কর।
রিমি হ্যাঁ-না কিছু বলল না। মনে হয় তার মত আছে। মত না থাকলে কঠিন গলায় না বলত। না শব্দটা এম্নিতেই খারাপ। সেই খারাপ শব্দটা কোমল গলায় বলা উচিত। রিমি তা বোঝে না।
দরজায় টোকা পড়ছে। রিমি দরজা খুলল, সার্কিট হাউসের এ্যাটেনডেন্ট। একদিনের পরিচয়েই সে হাসিমুখে ঘরের লোকের মতো জিজ্ঞেস করল, আপা কিছু লাগবে?
রিমি বলল, তোমাদের মশারি নেই? মশারি দেবে না?
মশা তো আপা নেই। তবু যদি বলেন; মশার ওষুধ স্প্রে করে দেব?
থাক দরকার নেই। উনার শ্বাসকষ্ট আছে। মশার ওষুধের গন্ধ সহ্য করতে পারবেন না।
চা দেব আপাং চা খাবেন?
উনাকে এক কাপ দাও। উনি শোবার আগে চা খান। আচ্ছা, আমাকেও দিও।
তৌহিদ হাসিমুখে বলল, তোমার চা খাওয়াটা ঠিক হবে না। রাতের ঘুম নষ্ট হবে।
হোক। চল বাইরে বসি। বাইরে বসার চেয়ার দিয়েছে।
দুজনেই বারান্দায় চলে এল। তৌহিদের ঘুম পাচ্ছে। শেষ চা-টা খাবার জন্যে জেগে আছে। রিমিকে দেখে মনে হচ্ছে তার ঘুম পাচ্ছে না। সমস্ত দিনের ক্লান্তির কিছুই তার চোখে নেই। তৌহিদ চেয়ারে বসতে-বসতে বলল, এখান থেকে সমুদ্র দেখা যায় না। এরা সার্কিট হাউসটা উল্টো করে বানিয়েছে। আমরা বসেছি সমুদ্রের দিকে পিঠ দিয়ে।
রিমি কিছু বলল না। তাকে এখন কিছুটা বিষণ্ণ বলে মনে হচ্ছে।
তৌহিদ বলল, চুপচাপ বসে আছ কেন? কথা বল।
কথা বললেই তোমার সঙ্গে ঝগড়া হবে। কাজেই চুপচাপ বসে আছি।
ঝগড়া হবে কেন?
ঝগড়া হবে কারণ তুমি ফ্লাটা বাসে ফেলে এসেছ। ফ্লাটা সারাক্ষণ তোমার সঙ্গে ছিল। নামার সময় তুমি নামলে ফ্লাস্ক ছাড়া।
বাদ দাও।
রিমি হাসিমুখে বলল, বাদ দিলাম।
তৌহিদ একটা হাত রিমির কোলে রাখল এবং সঙ্গে-সঙ্গে সরিয়ে নিল। ছেলেটা চা নিয়ে আসছে।
চা-টা ঠাণ্ডা। পানসে ধরনের। তবু রিমি ছোট-ছোট চুমুক দিয়ে খাচ্ছে। তার খাওয়া দেখে মনে হয় তার বেশ ভালো লাগছে। রিমি বলল, আমাদের পাশের কামরায় যে ভদ্রলোক থাকেন তার সঙ্গে কি তোমার কথা হয়েছে?
না, কেন বল তো?
এম্নি জিজ্ঞেস করছি। আমার সঙ্গে কথা হয়েছে। আমি একা-একা সমুদ্রের পাশে বসেছিলাম, ভদ্রলোক আমাকে এগিয়ে দিলেন।
তৌহিদ সিগারেট ধরাতে-ধরাতে বলল, আমি আগ বাড়িয়ে কখনো কথা বলি না। কথা বললেই এক সময় বের হয়ে যাবে আমি একজন স্কুল মাস্টার। স্কুল মাস্টারদের সম্পর্কে লোকজনদের ধারণা ভালো না।
লোকজনদের কী ধারণা?
বেশিরভাগ মানুষেরই ধারণা, এরা কিছুই জানে না। এক দঙ্গল ছাত্র পড়ানোর বাইরে এদের কোনো জগৎ নেই। বদমেজাজি শুকনো রসকষহীন মানুষ।
ধারণা কি ভুল?
না ভুল না। ঠিকই আছে।
চা শেষ করার পরেও তারা অনেকক্ষণ বাইরে রইল। তৌহিদ একটা হাত রাখল রিমির কোলে। নরম গলায় বলল, বেশ লাগছে, তাই না?